WordPress database error: [Disk full (/tmp/#sql_1df056_0.MAI); waiting for someone to free some space... (errno: 28 "No space left on device")]SELECT COLUMN_NAME FROM INFORMATION_SCHEMA.COLUMNS
WHERE table_name = 'sdsaw42_hsa_plugin' AND column_name = 'hsa_options'
WordPress database error: [Duplicate column name 'hsa_options']ALTER TABLE sdsaw42_hsa_plugin ADD hsa_options VARCHAR(2000) NOT NULL DEFAULT ''
সাদিয়া এইচ. তানহাঃ
ছেলেটির নাম দুখু মিয়া। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতাকে হারায় সে। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে দশে পড়তে না পড়তেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ইস্তফা দিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে। দুখু মিয়া নামের সার্থকতা যেন ছেলেটির জীবন বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
কিন্তু না। দুঃখ-বিষাদের কাব্য হয়ে পরিসমাপ্তি ঘটেনি ছেলেটির জীবনের। বরং সৃষ্টি সুখের উল্লাসের এক অমর গাঁথা হিসেবে মূর্ততা লাভ করে তার জীবন। অসীম প্রতিভা, জীবন-মানুষ-সমাজ-দেশের প্রতি তীব্র কর্তব্যবোধ, অনেক নেই এর মধ্যেই নিবিড় কাব্যসাধনা তাকে বাংলা ভাষার এ যাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম একজনে পরিণত করেছে। এ কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি প্রেম ও দ্রোহের কবি, এক শতাব্দী আগেই অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গাওয়া কবি, নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অস্বীকার করা কবি, প্রলেতারিয়েতদের অধিকারের পক্ষে বজ্রকণ্ঠ কবি। এই কবি আমাদের রণসঙ্গীতের রচয়িতা ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ তাঁর ১১৬ তম জন্মবার্ষিকী।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫মে, বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। পিতা ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তিনি শৈশবে মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন এবং পিতার মৃত্যুর পর নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। এই পরিবেশ নজরুলকে ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান ও জীবনদর্শন সম্বন্ধে অভিজ্ঞ করে তোলে যার ছাপ পরবর্তীতে তাঁর কাব্যে সুস্পষ্ঠভাবে লক্ষ্য করা যায়।
নজরুলের কবিতায় আরবী-ফার্সির ব্যবহার লক্ষনীয় ও চিত্তাকর্ষক। হাদিস-ফিকহ-কুরআন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অপূর্ব সুন্দর সব কবিতা লিখেছেন তিনি। কিন্তু নিজের সাহিত্যে আরবী-ফার্সি, ইরান-তুরানের প্রবল উপস্থিতি সত্বেও তাঁর বাংলা ভাষার সঙ্গে কোন বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। বরং তৎসম-তদ্ভব শব্দের ব্যবহারেও তিনি দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। বাঙালিত্ব আর ইসলামকে এত চমৎকারভাবে একসূত্রে গাঁথতে পারেননি কোন কবি। এখনো আকাশে শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ দেখা গেলে নজরুলের অমর সৃষ্টি “ও মন রমযানের ওই রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ” না বাজিয়ে বাঙালি মুসলমানের ঈদের উদযাপন সম্পূর্ণ হয় না।
শুধু ইসলাম থেকেই লেখার উপকরণ সংগ্রহ করেননি নজরুল। তাঁর কবিতা ও সাহিত্যে অবিভক্ত ভারতের বিশাল হিন্দু জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, আচার-অনুষ্ঠান, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিও সগৌরবে লিখিত হয়েছে। তিনি লেটো গানের দলে কাজ করার সময় প্রচুর পুরাণ ও হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন, যা তাকে হিন্দু সংস্কৃতি বিষয়ে জানতে ও তা কবিতায় দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে সাহায্য করেছে।
ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয়রা ছিল শোষিত, নিপীড়িত ও খানিকটা ভীরু। তাদের ভীরুতা ভেঙ্গে দিতে নজরুল কলমকে পরিণত করলেন তরবারিতে। নিজের দ্রোহপূর্ণ কবিতাগুলোতে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আনতে থাকলেন হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীদের কথা। কারণ নজরুল চাইছিলেন ভারতবাসীর মধ্যে শক্তি জেগে উঠুক, যোদ্ধার রক্তপিপাসা জেগে উঠুক। আর হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীরা একেকজন শক্তির আধার। তাই দেব-দেবীদের তিনি কবিতায় আনলেন শক্তির প্রতীক হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় “আনন্দময়ীর আগমণে” কবিতাটির কথা। যেখানে তিনি লিখলেন –
“মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।”
এই কবিতাটি থাকার কারণে ধূমকেতুর সে সংখ্যাটি নিষিদ্ধ হয় এবং নজরুলের ১ বছরের কারাদণ্ড হয়।
নজরুল একই কলমে লিখেছিলেন হামদ-নাত ও শ্যামা সঙ্গীত। তাই তাঁর কাছ থেকে যে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার পাঠ আসবে সেটাই স্বাভাবিক।
নজরুল লিখেছেন,
“গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।”
শুধু তাই নয়, নজরুল ধিক্কার দিয়েছেন যারা দেশসেবা, জনসেবা করতে গিয়ে ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ করে। “কান্ডারী হুশিয়ার” কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার”
সাম্যবাদ কেবল ধর্ম বা জাত-পাতের বেলায় নয়, নজরুল সাম্যবাদী ছিলেন রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকেও। তিনি সমাজের কৃষক, শ্রমিক, কুলি , মজুরদের আপনজন ছিলেন। সমাজের এই শোষিত প্রলিতারিয়েত শ্রেনীর জন্য তিনি কলম ধরেছিলেন মমতা ও ক্রোধ মিলিত চেতনা বুকে নিয়ে। “কুলি মজুর” কবিতায় কবি লিখেছেন –
“তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে”
নজরুল সাম্যবাদী ছিলেন সহস্র বছরের পুরনো নারী, পুরুষের বৈষম্যের প্রশ্নেও। কবির অমর কবিতা “নারী”তে তিনি লিখেছেন,
“সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!”
এমনকি নারীর অপরাধী স্বরূপের সেমিটিক ব্যাখ্যাও তিনি খণ্ডন করেছেন অসাধারণভাবে। লিখেছেন –
“নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।”
নজরুল ছিলেন ভারতের পরাধীনতার শেকল ভাঙ্গার লড়াইয়ে এক অক্লান্ত সৈনিক। ত্রিশের দশকের পঞ্চপান্ডব কবিরা যখন বিচ্ছিন্নতাবোধের কবিতা চর্চা করছিলেন, তখন কবিদের আরেকটি শ্রেনী ব্রিটিশের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। আর তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সর্বাগ্রে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর পত্রিকা ধূমকেতুতেই সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দাবি করা হয়।
আজীবনের সাম্যবাদী এই কবি মাত্র ৪৪ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বিদ্রোহী কবি যদি আরো কিছুদিন সুস্থ্য থেকে কাব্যচর্চা চালিয়ে যেতে পারতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই বাংলার সাহিত্যভান্ডার আরো অমূল্য সব রত্ন্ররাজিতে সমৃদ্ধ হত।
আজ সমাজে হানাহানি, মানুষে মানুষে বৈষম্য, নারী নির্যাতন, ধর্মীয় হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাপী মানুষের পরাধীনতার শৃঙ্খল দিনকে দিন শক্তিশালী হচ্ছে। এমন অন্ধকার সময়ে নজরুল ও তাঁর সাম্যবাদী মূল্যবোধকে হৃদয়ে ধারণ করা ও তার চর্চা করা আমাদের নিজেদের স্বার্থেই বড় প্রয়োজন; সমাজে আলো ফিরিয়ে আনার জন্য।
প্রতিক্ষণ/এডি /সাদিয়া