‘এক গৃহবধূর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গল্প’
জাকারিয়া আহমেদ:
১৯৮১ সালের ৩০ মে। চট্টগ্রাম সার্কিটহাউজে ঘটে একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। বিপথগামী কতিপয় সেনাসদস্যের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে শহীদ হন তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ঘাতকের বুলেট বিএনপি প্রতিষ্ঠাতার প্রাণ কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় স্বামীহারা এক স্ত্রীর অন্তরাত্মাকেও। যা কালবৈশাখীর মতো মুহুর্তেই তছনছ করে দেয় তাঁর সাজানো সংসার। রীতিমতো পাল্টে দেয় নিভৃতচারী এক নারীর জীবন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে স্বামী হারিয়ে ছোট দুই সন্তান ও বিপর্যস্ত বিএনপিকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন বেগম খালেদা জিয়া। তবুও হাল ছাড়েননি এতটুকুও। অবিচল আস্থা আর দৃঢ় মনোবল নিয়ে সংসার সামলানোর পাশাপাশি হাল ধরেন বিএনপির। আর এভাবেই এক বাঙালি গৃহবধূ হয়ে ওঠেন আপোষহীন নেত্রী।
বেগম জিয়ার রাজনীতিতে আসাটা তখন চমকের মতোই ছিল অনেকের কাছে। বিশেষ করে তখনকার রাষ্ট্রশাসক জেনারেল এরশাদ সরকারের কাছে রীতিমতো ভয়ের কারনও ছিল। কারন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য বেগম জিয়াই সেসময় সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হতে পারতেন। আর এই বর্ণনা পাওয়া যায় বিএনপির প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখা ‘চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা’ বইয়ে।
বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বার্ধক্য ও দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষের কারনে তখনকার বিএনপির একাংশ বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে। যদিও রাজনীতির প্রতি তাঁর সেই অর্থে কোন আগ্রহ ছিল না। কারন জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় তখন বেগম জিয়াকে প্রকাশ্যে তেমন একটা দেখা যেত না। তাছাড়া তিনি লাজুক প্রকৃতির ছিলেন এবং তারেক রহমান (পিনো)ও আরাফাত রহমান (কোকো) কে নিয়ে সাংসারিক কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। বেগম জিয়ার জীবনযাত্রার এমন বর্ণনা লাল গোলাপখ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমানের “সংগ্রামী নেত্রী খালেদা জিয়া” লেখায়।
যদিও রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড বেগম জিয়ার মনে গভীর দাগ কোটেছিল এবং তাঁর চিন্ত চেতনা ও জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছিল। আর এ থেকেই রাজনীতির ময়দানে আসেন তিনি। প্রথমে দলের সদস্য ও কিছুদিনের মধ্যে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এরই মধ্যে দানা বাঁধে স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলন।
যে আন্দোলন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে আরো শাণিত, বলীষ্ঠ ও পরিণত করে। যা তাকে বিএনপির শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। যদিও বিএনপির বাইরে অন্য রাজনৈতিক দল থেকেও বেগম জিয়াকে দলের নেতৃত্ব নেয়ার আহবান জানানো হয় যা বাম নেতা হায়দার আকবর খান রনো তাঁর “শতাব্দী পেরিয়ে” বইয়ে তুলে ধরেছেন।
ঊনিশশো আশির দশকে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন বেগম খালেদা জিয়া।এরশাদ সরকারের আমলে একাধিকবার আটক হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি তিনি। স্বৈরশাসকের পতন আন্দোলনের এই সফলতাই তাকে এনে দেয় আপোষহীন নেত্রীর তকমা। বেগম খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়ের নাম। তাঁর একক নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে জাতীয়তাবাদী দল। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ও দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া।
এরপর ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনার মূল কারিগরও বেগম জিয়া। তিনি যতবার যতগুলো আসন থেকে নির্বাচন করেছেন কখনোই পরাজিত হননি। যদিও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিতর্ক ঘিরে ধরে বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে। যা ঘনীভূত হতে থাকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা থেকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান আটকের মধ্য দিয়ে। এরপরই আওয়ামী লীগের লগি বৈঠার আন্দোলন বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেনের সূত্রপাত করে।
ফখরুদ্দিন-মইন উদ্দিনের করা ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয় বিএনপি আর সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হন বেগম খালেদা জিয়া। শুরু হয় বিএনপির আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। বেগম জিয়া হারান বিরোধী দলীয় নেতার মর্যাদাও।
২০১৮ সালের নির্বাচনে যাতে বিএনপি চেয়ারপারসন অংশ নিতে না পারে সেজন্য তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের করা দুর্নীতির মামলা সামনে আনে আওয়ামী লীগ সরকার। শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সেই মামলায় আদালতের রায়ে তাকে কারাগারেও যেতে হয়। দুই বছরেরও বেশি সময় তাকে থাকতে হয়েছে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে। শরীরে তাঁর বাসা বাঁধে মরণব্যাধি। তবুও তাকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়নি। তিনি চাইলেই সমঝোতা করে বিদেশে যেতে পারতেন কিংবা আয়েশে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো আপসহীন। কোন অন্যায় বা প্রলোভন তাকে টলাতে পারেনি এতটুকুও।
ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে চারদেয়াল মুক্ত হন বেগম খালেদা জিয়া। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলার নাগপাশমুক্ত হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান লন্ডনেও। চার মাসের চিকিৎসা শেষে নেতাকর্মী ও দেশের মানুষের মাঝে আবারো ফিরেছেন বিএনপি প্রধান। এই ফিরে আসা শুধু শারীরিক নয়, ছিল মানসিক প্রত্যাবর্তনও। যা নেতাকর্মীদের সাহস যুগিয়েছে নতুন করে আবারো লড়ার ও স্বপ্ন দেখার।
জনগণের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা আর দোয়াই যেন তাঁর বড় প্রাপ্তি। যাকে পুঁজি করেই সাড়ে চার দশক ধরে গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা তাকে শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন, বরং লাখো বিএনপি কর্মী ও সমর্থকের কাছে সাহস, সংগ্রাম ও অনুপ্রেরণার প্রতীকে পরিণত করেছে।
বেগম খালেদা জিয়া তার ভিশন ২০৩০ এ ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিএনপির রাজনীতি শুধুই ক্ষমতার জন্য নয়, বরং আদর্শের জন্য। সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মানের জন্য। এজন্যই তিনি শুধু বিএনপির নেতা নন বরং পুরো প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, সাহস আর আস্থার বাতিঘর।
জাকারিয়া আহমেদ
বিশেষ প্রতিনিধি
স্টার নিউজ
[email protected]
—————–