দক্ষিণডিহিতে প্রাণ নেই বটে, আছে ইতিহাস

প্রকাশঃ মার্চ ১১, ২০১৫ সময়ঃ ১:২৪ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:২৬ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:

1408685236.‘কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যারবি—
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কবিতার এই লাইন খোদাই করা আছে তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর আবক্ষ ভাস্কর্যে। খুলনার দক্ষিণডিহি গ্রামে কবির শ্বশুরবাড়ির দোতলা ভবনের সিঁড়ির দুই পাশে স্থাপন করা হয়েছে কবি ও তাঁর স্ত্রীর আবক্ষ ভাস্কর্য। তাতে প্রাণ নেই বটে, আছে ইতিহাস। ২৫ বৈশাখ এলে রবীন্দ্রভক্তরা ছুটে আসেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শ্বশুরবাড়িতে, রবীন্দ্র কমপ্লেক্সে। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে আসে হাজারো রবীন্দ্রানুরাগী। রবীন্দ্রনাথ আমাদের অস্তিত্বে মিশে আছেন শিকড়-বাকড়ের মতো। প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে ছুটে আসা মানুষ মনের খোরাক মেটাতে এমনই কথা বলেন।

ফুল, ফল আর বিচিত্র গাছগাছালিতে ঠাসা সৌম্য-শান্ত গ্রাম দক্ষিণডিহি। খুলনা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ফুলতলা উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গেলে দক্ষিণডিহি গ্রাম। গ্রামের ঠিক মধ্যখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতিধন্য একটি দোতলা ভবন। এটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি।

কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে দক্ষিণডিহির সম্পর্ক নিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই দক্ষিণডিহি গ্রামে। রবীন্দ্রনাথের কাকি ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী এই গ্রামেরই মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী দক্ষিণডিহিরই মেয়ে। তাঁর ভালো নাম ভবতারিণী।

যৌবনে পা দিয়ে কবি প্রায়ই তাঁর মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামাবাড়ি আসতেন। নিরঞ্জন রায়চৌধুরী ও হিরণ্ময় রায়চৌধুরী কবির দুই মামা। কবির মামাবাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির মধ্যখানে ছিল বিশাল এক পুকুর। নাম ‘তিতির পুকুর’। পুকুরটিতে ছিল শানবাঁধানো ঘাট। একদিন ‘ফেলী’ ওরফে মৃণালিনীর সঙ্গে তরুণ কবি রবির দেখা মেলে পুকুরপাড়ে। মৃণালিনীকে উদ্দেশ করে তিনি একটি ছোট্ট কবিতাও লেখেন,
‘মৃণালিনী ঘোমটা খোল
রবি তোমায় ডাকছে।’

মৃণালিনীকে বিয়ে করবেন বলে রবিঠাকুর জানিয়ে দেন। এরপর ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (বাংলা ১২৯০ সালের ২৪ অগ্রহায়ণ) রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মৃণালিনীর বিয়ে হয় জোড়াসাঁকোয়। বিয়ের পর ভবতারিণীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। ১৯০২ সালে (বাংলা ১৩০৯ সনের ৭ অগ্রহায়ণ) মারা যান মৃণালিনী দেবী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বেনীমাধব রায়চৌধুরী দেশ বিভাগের বহু আগে থেকে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর একমাত্র ছেলে নগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী ওরফে ‘ফেলুবাবু’ জমিদারি দেখাশোনার জন্য মাঝেমধ্যে দক্ষিণডিহি আসতেন। ফেলুবাবুর ছেলেরা (বীরেন্দ্র কিশোর, ধীরেন্দ্র কিশোর ও কৃষ্ণ ভূষণ) তখন কেউ দক্ষিণডিহি, আবার কেউ কলকাতায় বাস করতেন। ১৯৪০ সালে পরিবারের সবাই দেশ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। এর আগে ফেলুবাবু ও তাঁর স্ত্রী নলিনীবালা দেবী বাড়িসহ আশপাশের ৭ দশমিক ৮ একর জমি বাদে সমুদয় সম্পত্তি দক্ষিণডিহির আরেক জমিদার বিজনকৃষ্ণ দাসকে বন্দোবস্ত দেন।

বাড়ি ও সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয় নায়েব নবকুমার মুস্তাফিকে। ১৯৫৫ সালে ফেলুবাবুর ছেলে ধীরেন্দ্র কিশোর শেষবারের মতো দক্ষিণডিহি আসেন। ১৯৬৫ সালে বিজনকৃষ্ণ দাস দেশ ত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে নায়েব নবকুমার মুস্তাফির আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। ফলে বেদখল হয়ে যায় বাড়িটি।

স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এ বাড়িসহ সম্পত্তি দখল করে নেন। ৫০ বছর অবৈধ দখলে থাকার পর স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে বাড়িটি উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের। সেই থেকে এখানে প্রতিবছর বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হচ্ছে রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী। এভাবেই রয়েছে তাদের স্মৃতি আজও অমলীন। যা এখন রীতিমত সবার কাছে প্রিয় ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। ঐতিহ্য বহন করে আসছে এই বাড়ী।

প্রতিক্ষণ/এডি/আকিদ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G