জহির রায়হানঃ জীবন ও কর্ম

প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ১৮, ২০১৫ সময়ঃ ৫:০৪ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:১২ অপরাহ্ণ

সাহিত্য ডেস্ক,প্রতিক্ষণ ডট কমঃ

জহিরপ্রথম প্রথম কাউকে মরতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনও চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রুও হয়ত জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়ত অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। তাই মৃত্যুর খবর আসে। মরা মানুষ দেখি। মৃতদেহ কবরে নামাই। পরক্ষণে ভুলে যাই।

রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছোট্ট টিলাটার ওপরে এসে দাঁড়াই। সামনে তাকাই। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা। কচি লাউ ঝুলছে। বাতাসে মৃদু দুলছে। কয়েকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ। দূরে আর একটা গ্রাম…….

এই লাইনগুলো জহির রায়হানের গল্প “সময়ের প্রয়োজনে” থেকে নেয়া। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা এই গল্পে কী সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন সেই রক্তঝরা দিনগুলোর দৃশ্যকাব্য! এমনই সহজ, সাবলীল ও কাব্যময় উপস্থাপনায় চিরঞ্জীব তাঁর গল্প, উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র। তিনি জহির রায়হান, আমাদের জহির রায়হান, বাঙালির জহির রায়হান। তাঁর হাত ধরেই আমাদের চলচ্চিত্র প্রবেশ করেছে রেঁনেসায়, তাঁর লেখনির ছোঁয়ায় আমাদের সাহিত্য পেয়েছে আবহমান বাংলার মাটির সুর। তিনি একাধারে খ্যাতিমান ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, চলচ্চিত্রকার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী। তিনি মূলত মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার। চারপাশের মানুষের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার চিত্র তাঁর রচনাকে করেছে সমৃদ্ধ, চলচ্চিত্রে দিয়েছে প্রাণ। সমাজের নানা বৈষম্য ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধেও তাঁর কণ্ঠ ছিল বলিষ্ঠ।

জন্ম, ছেলেবেলা, শিক্ষাজীবন ও রাজনীতি

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। তিনি কলকাতার মিত্র ইন্সটিউট আলিয়া মাদ্রাসায় প্রাথমিক লেখাপড়া করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তাঁর পরিবারের সাথে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ফিরে আসেন। ১৯৫০ সালে ফেনীর আমিরাবাদ হাইস্কুল থেকে মেট্রিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা (বর্তমানে জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে আইএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। ১৯৫২ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফি স্কুলে (কলকাতা) ভর্তি হন। মেডিক্যাল কলেজে (১৯৫৬-৫৮) ভর্তি হয়েও, চিকিৎসাশাস্ত্রের কোর্স শেষ না করেই কলেজ ত্যাগ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (অনার্স) ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু’বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।

১৯৪৯ সালে কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকা থেকে ওদের জানিয়ে দাও নামে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্য গ্রহণ ও ১৯৬০ সালে প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে প্রকাশিত হয়।

১৯৫৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি: কলাভবন শীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলনের পর কলাভবন প্রাঙ্গণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ভাষা আন্দোলনের কর্মিগণ (ডান দিক থেকে, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, আমানুল হক, আহসানুল হক, মূর্তাজা বশীর, জহীর রায়হান প্রমুখ)।

১৯৫২ সালে ছাত্র অবস্থাতেই মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন এবং নাম পরিবর্তন করে মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ থেকে জহির রায়হানে পরিণত হন। ১৯৫১-৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

কর্মজীবন

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫০ সালে যুগের আলো পত্রিকার মাধ্যমে সংবাদ জগতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। এছাড়া তিনি ছাত্রজীবন থেকেই ইংরেজী সাপ্তাহিক এক্সপ্রেসের সম্পাদনা ও প্রকাশনার সাথে জড়িত ছিলেন। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাবেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির রায়হান এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়াতে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।

প্রতিক্ষণ/এডি/মন্ডল

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G