আমার দেখা কিছু মজার চরিত্র

প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ১১, ২০১৫ সময়ঃ ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ

রাকিব হাসান: শৈশবে কিছু বিচিত্র চরিত্রের সন্ধান পেয়েছিলাম যাদের আচরণ ছিল একবারেই উদ্ভট, খামখেয়ালীপূর্ণ এবং হাস্যরসাতœক। তবে একটি বিষয়ে তাদের দারুণ মিল ছিল তারা প্রত্যেকে প্রচন্ড একরোখা, কোন একটি বিষয়ে মেধাবী, সৎ এবং প্রতিবাদী। লোকে বলত অতিরিক্ত প্রতিভা-ই তাদের পাগলামির কারণ। আমাদের বাড়ির তিনটি বাড়ির পরই ‘দাস বাড়ি’ নামে একটি হিন্দু বাড়ি ছিল। সে বাড়ির ১৩/১৪ বছরের ছেলেটির নাম ছিল বিক্রম দাস। লোকে ডাকত বিক্রম পাগলা।

যেকোন গজল অথবা গান একবারের বেশি তার দুবার শোনার প্রয়োজন হতো না, কিভাবে যেন গানের কথা এবং সুর তার মুখস্থ হয়ে যেত। চেহারাটাও ছিল অদ্ভূত সুন্দর। মাথার চুল ছিল সজারুর মত খাড়া খাড়া, কানগুলোও ছিল দেখতে অনেকটা খরগোশের মত, পরণে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট আর গা ছিল উদোম, জুতা তাকে কখনও কেউ পড়তে দেখেনি। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত সব ঋতুতেই তার এই বেশ।

মাঘ মাসের এক হাঁড় কাপানো শীতের সকালে আমাদের বাড়ির উঠোনে বসে রোদ পোহাচ্ছে আর শীতের পিঠা খাচ্ছে বিক্রম পাগলা। মনোযোগ দিয়ে শুনছে সবার কথা। এরপর সবাইকে চমকে দিয়ে কিছুক্ষণ আগে আমার দাদা-দাদীর কাছে কীভাবে ‘চা’ চেয়েছিল- তা হুবহু কন্ঠস্বর নকল করে দেখাল।

ঘন্টাখানেক পর সে চলে যায়, আর আমার প্রিয় খেলনার গাড়ি এবং পুতুলটি উধাও হয়ে যায়। তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি, এগুলোই ছিল আমার সারাক্ষণের সঙ্গী। তাই কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় তুলি। দাদী তন্ন তন্ন করে সারাবাড়ি খুঁজেও কিছুই পায়নি। দুদিন পর বাড়ির সামনেই দেখি বিক্রম পাগলা।

আমাকে দেখে হাত থেকে কিছু একটা আনারস বাগানের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভৌ দৌঁড়। দেখি আমার সাধের গাড়িটির দুটি চাকাই ভাঙ্গা আর পুতুলটির লম্বা চুল এমনভাবে ছেটে দিয়েছে এগুলো খাড়া হয়ে আছে। যতবারই এটাকে হাতে নিই বিক্রম পাগলার চুলের সাথে এর কেমন যেন একটা মিল পেয়ে যাই। বিরক্ত হয়ে এটাকে রান্নাঘরের চুলায় নিক্ষেপ করি। দাদী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি বলি, কোনো কথা বলবে না, বিক্রম পাগলাকে আগুনে পোড়াচ্ছি।

এর দুদিন পরই বাড়ির সামনের পুকুর ঘাটের ঠিক কাছেই দেখি লাল শাপলা ফুটে আছে। অনেকক্ষণ ধরে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে এটাকে নেয়ার চেষ্টা করছি, পারছিনা। হঠাৎ পা পিছলে পানিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। পুকুর পাড়ের সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করছে কিন্তু কেউ আমাকে তুলছেনা।

দু-তিন লিটার পানি গিলে যখন আমি ক্লান্ত , পানির গভীর থেকে আরও গভীরে চলে যাচ্ছি, কোথ্থেকে যেন আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ একজন, কোলে তুলে নিয়ে আসে ঘাটে। তাকিয়ে দেখি ; আরে এ যে বিক্রম পাগলা। এরপর তাকে আর কখনও বকাঝকা করিনি। বছর খানেক পর স্ব-পরিবারে তারা ভারত চলে গেলে বিক্রম পাগলা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রতি বৃহস্পতিবার রাজ্যের সব ভিক্ষুক এসে জড়ো হত আমাদের গ্রামে। এ যেন ভিক্ষুক সম্মেলন। এ গ্রামের মানুষ বৃহস্পতিবার ছাড়া ভিক্ষা দেয়না। এ অঘোষিত আইন কে কবে করেছিল তা কারও জানা না থাকলেও নির্দিষ্ট ঐ দিনে হাজির হয়ে ভিক্ষুকরা শুধু ভিক্ষা নয়, খাবারও দাবি করত।

গ্রামবাসী সাধ্যমতো তাদের আবদার মেটাত। তবে বাচ্চাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি নির্দিষ্ট ভিক্ষুকের প্রতি। সব ঋতুতেই পায়ে ছেঁড়া একজোড়া প্যাগাসেস কেড্স, কটকটে কমলা রঙের পাঞ্জাবী, আর সাথে গাঢ় নীল প্যান্ট পড়ত এ ভিক্ষুক। তবে এক পায়ের প্যান্টের কাপড় সবসময় উঠানো থাকত। সাদাপাকা দাড়ি। চালচলনে আর বেশভূষায় সে কিছুটা নায়কোচিত ভাব করত, যেন পৃথিবীর সব সুখই সে কিনে নিয়েছে। তার সামনে অন্য ভিক্ষুকরা ঝগড়া করলে লাঠি-পেটা করত।

তার চোখের পুরনো চশমাটি যেকারো নজর কাড়ত। মজার বিষয় হচ্ছে চশমার একপাশে কাঁচ ছিল আরেক পাশে ছিলনা। চশমার একটামাত্র ফ্রেম, তাকে কি? আরেকটা অংশ দড়ি দিয়ে তার কানের সাথে বাঁধা ছিল। দূরের যে গ্রাম থেকে সে আসত ঐ গ্রামের নামটিও অদ্ভুত-‘গাংরাইয়া’। গ্রামের নামেই তার নাম হয়ে যায় গাংরাইয়া পাগলা। অনেকে তাকে ডিম পাগলা বলেও ডাকত। তার খাবারে ভাতের সাথে ডিম ভাজা থাকতেই হবে। মাছ-মাংস যে যাই দিক সে খেত না, যতক্ষণ ডিম দেওয়া না হতো-বসে থাকত। শুধু ভাত আর ডিম হলেই তার চলে। সে যেসব শ্লোক এবং পুঁথি সুরে সুরে পাঠ করে ভিক্ষা চাইত সেসবের বিষয়ও ছিল ডিম।

কেউ চালের পরিবর্তে ডিম ভিক্ষা দিলে লম্বা মোনাজাত দিত। বাচ্চাদের অনুরোধে ডিম নিয়ে তার নিজস্ব কথা ও সুরে গান করত এবং সাথে চলত পাগলা নৃত্য। বাচ্চারা ওর নাচের নাম দিয়েছিল ব্যাঙ নাচ। এই নাচ থেমে থেমে চলত ঘন্টা খানেক। নাচ দেখার জন্য ছেলেবুড়ো সবাই জড়ো হতো। তবে নাচ শেষ হবার সাথে সাথে ডিম ভাজা এবং ভাত এনে দিতে হবে। দেরি হলে তার হাতের লাঠি দিয়ে ঐ বাড়ির টিনের চাল পিটিয়ে সমান করে দিয়ে চলে যেত।

তখন ক্লাস ফাইভে। নানা বাড়িতে বেড়াতে যাই। নানী ভাত খেতে বলছে কিন্তু আমি পিঠা ছাড়া অন্য কিছু খাবনা। নানী ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়, হঠাৎ দেখি কালো কুচকুচে হুতুম প্যাঁচার মতো এক মহিলা চোখ কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, হাতে তার একটা লাঠি। আমাকে ধমক দিয়ে বলেছে ‘ভাত খা , তুই না খেলে তোর বাপ খাবে ; মেরে পিঠের চামড়া উঠিয়ে নেব, হারামজাদা…খা-বলছি-খা। আমি ভয়ে ভয়ে খাওয়া শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর পাগলীটা চলে গেল।

নানী এসে বলল ভয় পাসনা, ওটা নতুন কাজের মেয়ে- মরিয়ম। কাজকর্ম ভাল কিন্তু একটু পাগল। ওই পাগলী বাড়ির সব কাজ একাই করতে চাইত, পারতপক্ষে বাড়ির কাউকে কোন কাজ করতে দিতনা। ঘন্টায় ঘন্টায় চা খাওয়া নানা ভাইয়ের অভ্যাস। নানাভাই অবাক, চা চাওয়া মাত্রই চা হাজির। নানা-নানী, খালা, মামা-মামীদের সব কাপড় চোপড় ধুয়ে দিত মরিয়ম পাগলী।

শুধু শর্ত হচ্ছে বাংলা-৫৭০ সাবান যতটুকু ইচ্ছে (২কেজি/৩কেজি যাই লাগুক) সে খরচ করবে- এ বিষয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না । এতেই সে সন্তুষ্ট। বাড়ির রান্নাবান্নার বিষয়ে তার কিছু অলিখিত নিয়ম ছিল। সেই সব রান্না করবে। যত খাবারই থাকুক সে প্রতিদিন তার তৈরি স্পেশাল শুটকির ভর্তা খাবে, নানী ছাড়া এর ভাগ আর কেউ পাবে না। যখন সে রান্না করবে তখন কারও রান্নাঘরে যাওয়া পছন্দ করত না। ঐসময়ে কেউ রান্নাঘরে এসে যদি কোন কিছু স্পর্শ করত, তবে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠত। থালাবাসন, ডেকচি এদিক সেদিক ছুঁড়ে মারত, তাতেও কাজ না হলে কান্নাকাটি জুড়ে দিত।

তার কারণে মামীদের রান্নাঘরে যাওয়াটাই একরকম নিষিদ্ধ হল। তার রান্নাবান্না-কাজকর্ম সবই ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তাই সবাই নিরবে সব সহ্য করে যেত। প্রায়ই মামীদের সাথে ঝগড়া বেঁধে যেত। বিষয়টি একসময় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে নানী তাকে বিদায় করে দেয়। যাবার সময় পরিবারের সবার জন্য তার সে কী কান্না !!! নানী বলেন, যখন মনে হবে চলে আসবি। প্রথম দু-একবার এলেও সে পরে আর আসেনি। এরপর অনেক কাজের মেয়ে এসছে-গেছে কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং বিশ্বস্ততার দিক থেকে নানীর কাছে সেই ছিল সেরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই পরিচয় হয় মজার এক চরিত্রের সঙ্গে। নাম তার শফিকুল বারী। থাক… বারী ভাইয়ের কথা আরেকদিন বলা যাবে। ….(চলব

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G