শব্দ শ্রমিক রুদ্রের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী

প্রথম প্রকাশঃ জুন ২১, ২০১৬ সময়ঃ ৫:১২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৫:১২ অপরাহ্ণ

সাদিয়া এইচ. তানহাঃ

rudro

“এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।”

অনেকে তাঁকে ৭০ এর দশকের কবি বলে দাবি করেন। কিন্তু দেখুন তো উপরের কটি লাইন। এর প্রাসঙ্গিকতা কী আপনি এখনো, এই ২০১৬ সালেও খুঁজে পান না? আমি নিশ্চিত পান। এ এক কালোত্তীর্ণ কবিতা “বাতাসে লাশের গন্ধ” এর ৩ টি লাইন। এ কবিতা যিনি লিখেছে সেই কালোত্তীর্ণ দ্রোহের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আজ ২৪ তম মৃত্যুবার্ষিকী। সাম্যবাদী মতাদর্শ থেকে যিনি নিজেকে কবি নন, দাবি করেছিলেন শব্দ শ্রমিক বলে।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্ম জীবনানন্দের বরিশালে। সেখানে তাঁর পিতার করমস্থল ছিল। তবে তাঁর মূল বাড়ি বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে। তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৪টি বছর। এই স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং ভালো আছি ভালো থেকো সহ অর্ধ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।

রুদ্র ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পিতা ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। বাংলার সংখ্যাগুরু পিতাদের মতো তিনিও চাইতেন ছেলে ডাক্তারই হোক, নিজের মতো। কিন্তু প্রচলিত সামাজিক ধ্যান-ধারণার প্রতি অনেক আগেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন রুদ্র। একটা সময় বাবার মতো নিজেরও ইচ্ছা ছিল চিকিৎসক হওয়ার। বাবার কাছে লেখা চিঠি “আব্বা”তে এ নিয়ে দুঃখপ্রকাশও করেন তিনি। কিন্তু মাত্র নবম শ্রেনীতে পড়াকালীন প্রত্যক্ষ্য করা মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, দেশব্যাপী পৈশাচিক হত্যা-নির্যাতন তার ভাবনার জগতকে তুমুলভাবে আলোড়িত করে, তার চিন্তার ধারা ও জীবনের লক্ষ্য পালটে দেয়। তিনি কলমকে অস্ত্র বানিয়ে লেখা শুরু করলেন সমাজের সকল অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। জাতির জীবনের প্রত্যেকটি ক্রান্তিলগ্নেই গর্জে উঠেছে তাঁর কলম।

পচাত্তরে যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির যখন পুনরুত্থান ঘটে তখন রুদ্র লিখলেন,
“স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম ?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?
জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন”

আবার স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও চুপ না থেকে শক্তিশালী কলমে তেজোদ্দীপ্ত শব্দের বুনটে রুদ্র লিখলেন,
“দাঁড়াও‌, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?
রাইফেল তাক কোরে আছো মানুষের দিকে।
সঙ্গিন উঁচিয়ে আছো ধূর্ত নেকড়ের মতো।
পায়ে বুট, সুরক্ষিত হেলমেটে ঢেকে আছো মাথা।
সশস্ত্র তোমার হাত, সংগঠিত, কে তোমাকে ছোঁয়!”

৭৫ থেকে ৯০, বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনেই সশরীরে অংশগ্রহণ করেন রুদ্র। এমনকি ৬৯ এর গণঅভ্যুথ্থানে মাত্র ১৩ কি ১৪ বছর বয়সেই অংশ নেন তিনি।

রুদ্রের কলমকে অস্ত্র বানানোর পেছনে কি কাজ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করতে না পারার গ্লানি? হতেও পারে। কারণ আজীবনের যোদ্ধা রুদ্র যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন যুদ্ধে যাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। কিন্তু এর মাঝে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার দায়ে ধরে নিয়ে যায়। পরিবারের এমন দুর্দিনে তাই তার মা তার অনেক অনুনয় বিনয়ের ফলেও যুদ্ধে যেতে দিতে রাজি হয় নি।

রুদ্র শুধু দ্রোহের কবিই ছিলেন না প্রেমের কবিও ছিলেন। তাঁর অসাধারণ সব প্রেমের কবিতা আছে। তিনি অপূর্ব ছন্দে লিখেছেন,
“সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি
সহজে থাকি না কাছে,
পাছে বাঁধা পড়ে যাই।
বিস্মিত তুমি যতোবার টানো বন্ধন-সুতো ধ’রে,
আমি শুধু যাই দূরে।“

তাঁর সে বিখ্যাত কবিতা কখনোই ভুলবার নয়, যা পরে গান হিসেবেও তুমুল খ্যাতি পায়,
“ভালো আছি, ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি,
বাউলের এই মনটা রে।

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।“

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর পর “ভালো নেই, ভালো থেকো” গল্পে তাঁর স্ত্রী তসলিমা নাসরিন রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন –
“তোমার কি এরকম ইচ্ছে হয় না আবার একদিন পাখি হয়ে উড়ে উড়ে ফিরে আসতে, যেখানে ছিলে সেখানে, সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে? ইচ্ছে তোমার হয় না – এ আমি বিশ্বাস করি না। ইচ্ছে ঠিকই হয়। পারো না। অথচ একসময় যা ইচ্ছে হত তোমার, তাই করতে। ইচ্ছে যদি হত সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে, করতে। ইচ্ছে যদি হত সারাদিন পথে পথে হাঁটতে, হাঁটতে। ইচ্ছে যদি হত মেথরপট্টি গিয়ে পেট ভরে মদ খেতে, খেতে। কে তোমাকে বাঁধা দিত! জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিল, এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছ। আমার ভেবে অবাক লাগে জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই।”

এই কটা লাইনেই যেন কবির জীবনের সারাংশটা বুঝে নেওয়া যায়। সমাজ ও রাজনীতির প্রতি প্রবল কর্তব্যবোধ থাকলেও জীবনের প্রতি আসক্তিহীন, সম্পর্কের প্রতি দায়বদ্ধতাহীন, বোহেমিয়ান, উড়নচন্ডী এক মানুষ ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কিন্তু এটাই কি হওয়া উচিত একজন প্রতিবাদী কবির জীবন। নিজের জীবনের চেয়ে সমাজকে বেশি ভালোবাসা অবশ্যই মহান, কিন্তু নিজের জীবনের প্রতি ন্যুনতম যত্ন না নিয়ে, কাছে মানুষের সাথে সম্পর্কগুলোকে লালন না করে নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিলে তো নিজের সৃষ্টি, নিজের কর্মের মাধ্যমে সমাজ ও মানুষের উপকার করার সুযোগটাই কেবল হারানো হয়।

কিন্তু নিজের ও সমাজের সাথে এ অন্যায়টাই করেছিলেন রুদ্র। অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা ছিল তাঁর মজ্জাগত। ফলস্বরূপ আলসারে পেয়ে বসেছিল তাঁকে। ৭ বছরের দাম্পত্য শেষে বিতর্কিত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর শিমুল নামের এক মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে সম্পর্কটাও টেকেনি। বিপদে বন্ধুরাও সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছিলো। এমন সময় একা হয়ে যাওয়া কবির পায়ের আঙ্গুলে বাসা বেধেছিল রোগ। ডাক্তার বলেছিলো পা বাঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। তিনি পা ছেড়ে সিগারেট নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই স্থান হলি ফ্যামিলির ২৩১ নম্বর কেবিনে। এমনকি ৯১ সালের ২০ জুন ভালো হয়ে পশ্চিম রাজাবাজারের বাড়িতে ফিরেও গেলেন। কিন্তু সে বছরেরই ২১ জুন ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাংলা ভাষায় বিপ্লবী কবি রুদ্র। এ অসামান্য শব্দ শ্রমিকের জীবনের যবনিকাপাত ঘটলো এভাবেই। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী।

 

 

প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G