গারো পাহাড়ের বাতাসে সাঁইজির সুর

প্রকাশঃ নভেম্বর ২৬, ২০১৫ সময়ঃ ২:১৬ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ

সাহাদাত হোসেন

Hillতুমি দিন থাকিতে দিনের সাধন কেন করলে না, সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়, পারে লয়ে যাও আমায়’। বাংলার ভাবজগতের মুকুটহীন রাজা ফকির লালন সাঁইজির এমনি নানা গান আর একতারার সুরে মুখরিত থাকবে শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের ‘রাজার পাহাড়’।

পাহাড় আর নদীঘেরা শেরপুরের শ্রীবর্দীর সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়। সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। ভারতের মেঘালয় ঘেঁষে গারো পাহাড়ের অবস্থান। অবারিত সবুজের সমারোহ। রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য টিলা। যারা সে দৃশ্য দেখেছেন তারাই অনুভব করতে পারেন এ সৌন্দর্য। গারো পাহাড়ের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র ‘রাজার পাহাড়’। এ রাজার পাহাড়ে এবার যোগ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্রবাদপুরুষ লালন শাহের সুরের ঝর্ণাধারা।

এখানে ‘লালন কালচারাল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার জন্য চলছে জোড় প্রস্তুতি। এখন থেকে প্রতিনিয়তই শোনা যাবে বাউল গান। রাজার পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়া থেকে সাঁইজির গানের সুর ছড়িয়ে যাবে চারিদিকে। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে মনে হবে নীল আকাশের নিচে লালনের সুরধারায় ভাসছেন। দেখা যায় মেঘালয়ের সবুজ বনায়ন। কেউ একবার এলে বার বার ফিরে আসতে চাইবে। মনকে অবশ্যই বিমোহিত করবে।

এ পাহাড়ের সম্ভাব্য পর্যটন কেন্দ্রের পাশাপাশি লালন শাহর নির্মাণাধীন সঙ্গীতালয় বা ‘কালচারাল একাডেমি’ ভ্রমণ পিপাসুদের বিনোদনে যোগ করবে নতুন মাত্রা। বিস্তার ঘটবে লালনের আধ্যাত্মিক সংগীত ধারার। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে আরো মুখরিত হয়ে ওঠবে রাজার পাহাড়।

সম্প্রতি সরেজমিনে এলাকাবাসী, ভ্রমণ পিপাসু, পর্যটক, স্থানীয় জনপ্রনিধি, প্রশাসন ও লালন ভক্তসহ বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এখানে স্থায়ীভাবে লালন কালচারাল ইনস্টিটিউট করার জন্য ইতোমধ্যে প্রায় ৫ একর জমি বন্দোবস্তের প্রক্রিয়া চলছে। লালন একাডেমির উদ্বোধন উপলক্ষে অচিরেই অনুষ্ঠিত হবে ফকির লালন সাঁইজির ১২৫তম তিরোভাব বার্ষিকী স্মরণে তিন দিনব্যাপী প্রথম নিখিল বঙ্গ বাউল সঙ্গীত সম্মেলন। ভারত ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত বাউল শিল্পীরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে। ইতোমধ্যে এখনে একটি ছনের ঘর তৈরি করে প্রস্তুতি চলছে বলে জানান আয়োজকরা।

আয়োজকদের একজন মহিউদ্দিন সুজন টারজান ফকির লালন ভক্ত। তিনি এসেছেন সিরাজগঞ্জ থেকে। তিনি লালন ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ইনস্টিটিউটের ছাত্র। তিনি জানান, ফকির লালন সাঁইজির চৈতন্য জ্ঞানকে বিকশিত করতে এ উদ্যোগে নেয়া হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক ও লালন বিশ্ব সংঘের সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান। সার্বিক পরিচালনায় প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুল মান্নান।

এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে উপজেলা প্রশাসনও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে রাজার পাহাড়ের চূড়ায় মাইক্রোবাসসহ অন্যান্য যানবাহন ওঠার মতো রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পানির জন্যে বসানো হয়েছে টিউবওয়েল। অন্যান্য কার্যক্রমও অব্যাহত। সম্প্রতি পরিদর্শনে এসেছিলেন শ্রীবর্দী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবা শারমিন।

কর্ণঝোড়া ভূমি অফিসের নায়েব আজাহারুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি লালন কালচারাল ইনস্টিটিউটের কর্তাব্যক্তিরা শেরপুর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে রাজা পাহাড়ের ওই স্থানটি নির্ধারণ করেছে লালন কালচারাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাদের দাবি অনুযায়ী সম্প্রতি ভূমি জরিপের কাজ শেষ করা হয়েছে এবং স্থানীয় রাস্তা-ঘাট সংস্কার করা হয়েছে। ইনস্টিটিউটের জন্য ৫ থেকে ৬ একর জমির চাহিদা থাকলেও এখনও জমি বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি।

রাজার পাহাড় নিয়ে রয়েছে কিংবদন্তি। প্রাচীনকালে সামন্ত রাজবংশের জনৈক রাজার অবস্থান ছিল এখানে। পরবর্তীতে ওই রাজার নামে পাহাড়ের নাম হয় ‘রাজার পাহাড়’। রাজার পাহাড়ের আগের সৌন্দর্য এখন আর নেই। তবে এর আলাদা বৈশিষ্ট্য এখনও বিদ্যমান। আশপাশের গারো পাহাড়ের তুলনায় এ পাহাড়টি একটু ব্যতিক্রমী। এখানে যতগুলো পাহাড় রয়েছে তার মধ্যে এর উচ্চতা সবচেয়ে বেশি। প্রায় দেড়শ ফুট উঁচু টিলা। পাহাড়ের চূড়ায় শতাধিক হেক্টর জমির সমতল ভূমি। সবুজ আর নীলের সংমিশ্রণ। যেন মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশছোঁয়া বিশাল পাহাড়। এর নৈসর্গিক দৃশ্য মনকে করে আবেগতাড়িত। এটি প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে ওঠেছে। চূড়া থেকে দেখা যায় মেঘালয়ের অনেক কিছু। এখানে প্রায়ই মানুষের ভিড়ে হয়ে ওঠে কোলাহলপূর্ণ।

শেরপুর জেলা সদর থেকে শ্রীবর্দী উপজেলা শহরের দুরত্ব ২০ কিলোমিটার। এরপর শ্রীবর্দী পৌর শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে গারো পাহাড়ের কর্ণঝোড়া বাজার ঘেষা’। সরকারিভাবে এ পাহাড়টি এখনও কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও প্রকৃতিকভাবেই এটি এখন পর্যটন ও বিনোদন স্পটে পরিচিত লাভ করেছে। বছরের প্রায় সময়ই বিশেষ করে শীত মওসুমে জেলা শহর এবং জেলার বাইরে থেকে এ রাজার পাহাড়ের নির্মল পরিবেশে বেড়াতে আসে শতশত মানুষ।

প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত রাজার পাহাড়ে ছিলেন পাগলা দারোগা নামে জনৈক এক ব্যক্তি। তিনি মারা যান ১৯৮০ সালে। তার ছেলে মেয়েরা টিলার এক কোনায় গড়ে তুলেন কাঁঠাল, লিচু ও কলার বাগান। অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত এ রাজার পাহাড়ের চারিদিকে হরেক রকম প্রজাতির গাছ গাছালি। আর এ গাছপালায় দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলতান যেন অন্য এক সুরের ভুবনে নিয়ে যায়। পাহাড়ের সুরু পথ বেয়ে যেতে হয় চূড়ার বিশাল সমতল ভূমিতে। অদ্ভুত নির্জন পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

প্রতিক্ষণ/এডি/এস. আর. এস

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G