বাংলাদেশের জন্য বেলজিয়াম তরুণের চাঞ্চল্যকর অপরাধ

প্রকাশঃ জুলাই ৪, ২০১৫ সময়ঃ ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডেস্ক

belgiam১৯৭১, পুর্ব বাংলায় তখন চলছে ভয়াবহ মৃত্যু উৎসব, মৃত্যু-ধ্বংস-পলায়ন- এ যেন নিত্যদিনের চিত্র! ছেঁড়া জীর্ণ কাপড়ে কোনরকমে নিজের শরীর ঢেকে রাখা এক মায়ের কোলে একটি অপুষ্ট শিশু, চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে! কিংবা পথের পাশে পড়ে থাকা মানুষের লাশ ছিঁড়ে খুবলে খাচ্ছে কুকুর… অথবা ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে লোকজন দ্বিগবিদিক ছুটছে জীবন বাঁচাতে… সবারই লক্ষ্য সীমান্ত পার হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে। দৃশ্যগুলি মুহুর্তেই অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যায়!

দেখে কেমন যেন ঘোড়ের মধ্যে চলে যান মারিও রয়ম্যান্স, মা-বাবা হারা বিশ বছরের এক বেলজিয়ান তরুণ। টেলিভিশনের নব ঘুড়াতে ঘুড়াতে ফ্লেমিশ এই তরুণ জানতে পারেন জায়গাটা পূর্ব পাকিস্তান যেখানে বিচ্ছিন্নতা দমনের নামে চলছে নির্বিচারে ভয়াবহ এক গণহত্যা। তরুণ মারিও বেশিক্ষণ আর এই দৃশ্য দেখতে পারলেন না, টিভি বন্ধ করে দিলেন কিন্তু মাথার মধ্যে টিভিতে দেখা দৃশ্যগুলো যেন ঘুরে ফিরে আসতেই থাকে, অসহায় মা-শিশু, প্রাণভয়ে ছুটতে থাকা মানুষের ছবিগুলো তার মনকে আলোড়িত করে ভীষণভাবে। তিনি চাইলেন তাদের সাহায্য করতে কিন্তু তার হাতে ছিল না যথেষ্ট টাকা যা দিয়ে তিনি এই অসহায় মানুষগুলোকে সাহায্য করবেন।

সুদূর ব্রাসেলসে বসে টিভিতে এই দৃশ্যগুলো দেখে নিজেকে আর কোনভাবেই স্থির রাখতে পারলেন না এই তরুণ।তিনি তখন ভয়ঙ্কর এক পরিকল্পনা ফাঁদলেন। তিনি যা করলেন বেলজিয়ামের ইতিহাসে আজ অবধি ঘটে যাওয়া সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অপরাধের তালিকায় শীর্ষেই আছে। ২৩শে সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস থেকে তিনি চুরি করলেন ১৭ দশকের শিল্পী ইয়োহান ভারমিয়ারের আঁকা ‘দ্য লাভ লেটার’ নামের মাস্টারপিসটি, যার মূল্য ছিলো ৫ মিলিয়ন ডলারের মত।

লা সয়েরে পত্রিকার একজন সাংবাদিক ওয়াল্টার শুল্ডেনকে মারিও জানালেন, চুরি যাওয়া ভারমিয়ার এখন তার কাছে আছে এবং মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করলেন ২০০ মিলিয়ন ফ্রাংক যার মূল্যমান চার মিলিয়ন ডলার। সাথে একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, টাকাটা তাকে নয়, পাঠিয়ে দিতে হবে ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থা কারিতাসের দপ্তরে। আর সেটা অবশ্যই ব্যয় করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় শরণার্থীদের পেছনে! সেইসাথে হুমকি দেন- মুক্তিপণ ছাড়া পেইন্টিংটা উদ্ধারের চেষ্টা করা হলে এটা চিরতরে হারিয়ে যাবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তিনি সেটা বিক্রি করে দেবেন ল্যাটিন আমেরিকার এক ক্রেতার কাছে। আর সেইসাথে জাদুঘরে বাকি যে ৩৯টা ভারমিয়ার আছে, সেগুলোও চুরি করবেন।

লা সয়েরের কাছে খবর পেয়ে ডাচ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে ব্রাসেলসে আসে। পেইন্টিংটা সত্যিই আসল কিনা সেটা যাচাই করার জন্য তারা একজন বিশেষজ্ঞ দিয়ে তা পরীক্ষা করার আবেদন জানায়। রাজি হয়না মারিও বরং দু’দিন পর ‘হেট ফক’ নামের আরেকটি পত্রিকায় টেলিফোন করেন তিনি সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলেন, ৬ অক্টোবরের মধ্যে মুক্তিপণ বাবদ ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক পরিশোধ না করলে তিনি পেইন্টিংটি বিক্রি করে দেবেন বলে হুমকি দেন।

শুধু তাই নয় সেই সাথে আরও কঠিন শর্ত আরোপ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য এই মুক্তিপণ পরিশোধের ঘটনাটা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। সেখানে চুক্তিপত্রে সই করার সময় ছবিটির বীমার দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ কোম্পানি গ্রায়েম মিলারকে উপস্থিত থাকতে হবে।

এতকিছু করেও শেষ রক্ষা হয়না মারিওর। হ্যাসেটের যে পেট্রোলপাম্প থেকে ফোন করেছিলেন মারিও তার অপারেটর ঘটনাটি শুনে ফেলেন এবং পুরষ্কারের লোভে খবর দেন পুলিশকে। গাড়িতে চড়ে বেশীদূর যেতে পারেননি মারিও। ধাওয়ার মুখে আশ্রয় নেন এক গোয়ালে। লিমবার্গের রবিনহুডকে দুটো গরুর মাঝখানে গোবরের স্তুপে কয়েকটা খড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে পুলিশ।

বেলজিয়ামবাসীদের মধ্যে কিন্তু উল্টো প্রতিক্রিয়া ঘটে যখন লিমবার্গের থিলের গ্রেফতারের খবরটি জানাজানি হয়ে যায়। তারা এই সহজ সরল তরুণের একটা মহৎ উদ্দেশ্যে এমন বেপরোয়া ও অভিনব উদ্যোগকে অপরাধ হিসেবে দেখতে রাজী হন না। বিভিন্ন মিডিয়া- সংবাদপত্রগুলো, রেডিও-টিভি তার পাশে দাঁড়ায়। এমনকি তিনি যেখানে কাজ করতেন সেই হোটেলের মালিক-কর্মচারীরাও রাস্তায় নামেন মারিওর নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে এবং পিটিশনে সাক্ষ্যর সংগ্রহে। সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে দাতব্য সংস্থাগুলো। থিল অব লিমবার্গের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেয় মারিওর আসল পরিচয়, জনতার আবেগ আর ভালবাসার কারণে প্রশাসন নরম হতে বাধ্য হয়। মাত্র দুই বছরের সাজা হয় মারিওর, কিন্তু ছয়মাস পরই মুক্তি পেয়ে যান তিনি।

প্রতিক্ষণ/এডি/নির্ঝর

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

April 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930  
20G