লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পালের নাও

প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৫ সময়ঃ ৫:৫২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৬:২০ অপরাহ্ণ

ফারজানা ওয়াহিদ

pal5

আমার শখের নৌকায়  কতো না যাত্রী উঠেছে, আবার নেমেছে। শখ থাকতেও যাত্রী আমি হতে পারিনি কখনোই কিন্তু মাঝি হয়েছি বহুবার। বহু বছর তরতর করে পাল তুলে ছুটেছি অযথাই, কখনো কাঁদা মাখানো উঠান ঘেষে আবার কখানো স্বপ্নের ধরণীর বুক চিরে।

সময়ের বিবর্তণ ও যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের ফলে বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতির ধারক। দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ঐতিহ্যবাহী পালের নাও।

pal4

এক সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-ঝিল, এমনকি সমগ্র উপকূল জুড়ে নয়নাভিরাম শোভা পেত বিচিত্র ধরণের পাল তোলা নৌকা। ভাটির অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের সঙ্গেই ছিল নদী, সাগর আর পালের নাওয়ের নাড়ি ছেড়া সম্পর্ক। পালের নাওকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন তাঁদের অমূল্য সৃষ্টি কবিতা, ছড়া, গল্প, গান পালা ইত্যাদি। প্রখ্যাত শিল্পীরা তৈরি করেছেন উঁচু মানের শিল্পকর্ম। শুধু দেশী কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বা রসিকজনই নন বরং বিদেশী অনেক পর্যটকের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পালের নাও।

বিভিন্ন আকার ও ধরণের নৌকাই ছিল দেশের সাধারণ মানুষের যাতায়াত ও পরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। আর এ সব নৌকা চালানোর জন্য পালের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুরপাল ইত্যাদি পালের ব্যবহার ছিল নৌকাগুলোতে।

pal1

পালের নৌকার পাশাপাশি মাঝিদেরও বেশ কদর ছিল এক সময়। প্রবীণ মাঝিরা নৌকা চালানোর বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের হিসেব রাখতে হত জোয়ার-ভাটার, বিভিন্ন তিথির এবং শুভ-অশুভ ক্ষণের। কথিত আছে- বিজ্ঞ মাঝিরা বাতাসের গন্ধ শুকে বলে দিতে পারতেন ঝড়ের আগাম খবর। রাতের আঁধারে নৌকা চালানোর সময় দিক নির্ণয়ের জন্য মাঝিদের নির্ভর করতে হত আকাশের তারার উপর। তাই আগেভাগেই শিখে নিতে হত কোন তারার অবস্থান কোন দিকে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্পন, যাত্রীবাহী গয়না, একমালাই নৌকা, কোষানৌকা, ছিপনাও, ডিঙিনৌকা, পেটকাটা নাও, বোঁচা নাও সহ বিভিন্ন ধরণের পালের নাওয়ের ব্যবহার ছিল। ২০-২৫ বছর আগেও দেখা যেত, দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে মাঝিরা নৌকার পাল উড়িয়ে দিয়ে ঢেউয়ের তালে-তালে উদাত্ত্ব কণ্ঠে ভটিয়ালি সুরের মূর্ছনায় মুখরিত করে তুলছে দিক-দিগন্ত। উদাস করা ভরদুপুরে এমন দৃশ্য আকৃষ্ট করত সকলকেই।

pal7

যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেলচালিত ইঞ্জিন।

মাঝেমধ্যে দুএকটা পালের নাও এখনো নদ-নদীতে দেখা যায়। তবে এক সময় হয়তো হারিয়েই যাবে আমাদের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পালের নাও। পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা ভুলে যাবে, ‘পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও…’ ইত্যাদি ছড়া কাটতে। বিচিত্র রঙের পালের বাহারিতে ঝলমল করবে না, এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল।

 

প্রতিক্ষণ/এডি/এফজে

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

April 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930  
20G