সম্ভাবনার পথে দিনাজপুরের খানসামা

প্রকাশঃ এপ্রিল ১৬, ২০১৭ সময়ঃ ৫:০৬ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৫:০৪ অপরাহ্ণ

ভূপেন্দ্র নাথ রায়, দিনাজপুর প্রতিনিধি:

মানচিত্রে খানসামা উপজেলা

দিনাজপুর জেলার উত্তরে, নীলফামারীর পশ্চিম এবং পঞ্চগড় দেবীগঞ্জের দক্ষিণে আত্রাই নদীর তীরে অবস্থিত খানসামা উপজেলা এখন অপার সম্ভাবনার দুয়ারে। ৬টি ইউনিয়ন ৫৭টি গ্রাম নিয়ে গঠিত এ উপজেলা ১৮৯১ সালে থানা এবং ১৯৮৩ সালে উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মোট আয়তন ১৭৯৭২ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১৫০৮৯২ জন।

এ উপজেলায় বহমান আত্রাই, ইছামতি ও বেলান নদী। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পুরাতন মুসলিম স্থাপত্যের আওকরা মসজিদ (কথা বললে প্রতিধ্বনি করে), চেহেলগাজী মাজার, আনন্দভূবন ও তাজ ওয়ার্ল্ড।

উপজেলাটি দীর্ঘদিন থেকে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পায়ন এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। ক্রমশ: অনেক পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে খানসামা উপজেলা আজ  উন্নয়ন-সম্ভাবনার পথে। যে খানসামার বিস্তীর্ণ ভূমির গঠন (ডাঙ্গা পাড়া, হোসেনপুর,  খানসামা, ঝাড়বাড়ী, টংগুয়া, সাবুদের হাটখোলা, কাচিনিয়া, ভুল্লার হাট, হাসিমপুর, পাকের হাট, বুড়ির বাজার) বেলে ও বেলে দোঁয়াশ। এ অঞ্চলের বেশীর ভাগ ভূমি কাঁশবনে ঢাকা ছিল। ফলে এক সময় কোন কৃষি কাজ হতো না। চাষীরা ডাঙ্গা প্রকৃতির ভূমি বলে কাঁশবনের ওপর নির্ভর করতো। কাঁশবন বিক্রি করে যা আয় হতো তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো।

আওকরা মসজিদ, খানসামা

অন্যদিকে মজুর শ্রেণির লোকজন কাজের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে জীবিকার খোঁজে যেতো। দরিদ্র-মধ্যবিত্ত শ্রেণি আউশের মোটা চাউল একবেলা-আধাবেলা খেয়ে জীবন যাপন করতো এক সময়। যব, কাউন, গম চাষাবাদ ছিলো এ অঞ্চলের মূল কৃষিজাত দ্রব্য। ভাতের বিকল্প হিসেবে কাউন কিংবা গমের ভাতের প্রচলন ছিল কিংবা দুবেলা গমের রুটিই ছিল নিত্যদিনের খাবার। কোনো দিন শুধু পান্তাভাত নিয়ে পরিবারের ছোট সদস্যদের মধ্যে প্রতিযোগীতা শুরু হতো। বর্তমানে সেখানে  তিন বেলা চিকন চালের ভাত খেয়ে আয়েশে দিন কাটাচ্ছে খানসামার মানুষ।

প্রতি বছর কয়েক হাজার হেক্টর ডাঙ্গা (উঁচু) জমিতে আগাম আলুর চাষ করা হচ্ছে যা ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে সরবরাহ করা হয়। চাষীরা মাত্র ৫০ থেকে ৮০ দিনে একর প্রতি এক লক্ষ থেকে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা নগদ আয় করছে। এ কারনে খানসামায় যে সমস্ত পতিত জমি কাঁশবনে ঢাকা ছিল তার তিল পরিমাণও এখন পড়ে নেই। সমস্ত জমি চাষাবাদের আওতায় এসেছে। ইরি-বোরোর পরিবর্তে এখন ভুট্টাচাষ ব্যাপক জায়গা দখল করে নিয়েছে। কারন এক একর জমিতে ৫০ মণ ইরিধান উৎপাদন হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা।

খানসামায় ভূট্রা চাষ

অন্যদিকে ভূট্টা সেখানে দুই হাজার থেকে সর্বোচ্চ আটাইশ শত কেজি উৎপাদন হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় এক থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত। অন্যদিকে রসুন পঞ্চাশ শতকের বিঘায় উৎপাদন হচ্ছে চল্লিশ থেকে ষাট মণ পর্যন্ত যার বাজার মূল্য গড়ে পাঁচ হাজার করে প্রায় দুই থেকে তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত এবং একর প্রতি চার থেকে ছয় লক্ষ টাকা। আগাম আলু চাষের পর ভুট্টা, করলার চাষ জনপ্রিয় হয়েছে। খানসামা উপজেলা এখন সারা দেশের মধ্যে রসুন চাষে অদ্বিতীয় । বিত্তশালী থেকে মধ্যবিত্ত এবং মজুর-শ্রমিক শ্রেণি এখন রসুন চাষে আগ্রহী । দিনাজপুর খানসামায় ৫০ শতাংশের বিঘা প্রতি রসুন ৪০-৫০ মণ পর্যন্ত উৎপাদন হচ্ছে। ফলে দারিদ্রের কষাঘাত নামক অভিশাপ আর নেই। নদীর দু’পাশের পতিত জমিগুলো আর পড়ে নেই। সেখানেও ভুট্টা, আলু কিংবা ইরি চাষ হচ্ছে। উচু ধরনের জমিতে লিচু বাগান করা হয়েছে, নতুন করে বাগান হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত বেকার মাছ চাষ কিংবা তেজপাতার বাগান করে বেকার সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসছে।

খানসামা উপজেলার আদিবাসি শিরিল মুরমূ, লিওনসহ অনেক যুবক বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচতে তেজপাতার বাগান করে আজ  সফল। এই তেজপাতার বাগান তাদের জীবনে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। কৃষি নির্ভর খানসামার মানুষ আজ  তাদের সন্তানদের মানস্মত স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ নির্বাহ করে যাচ্ছে। মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নিরলস প্রচেষ্টায় প্রতিটি গ্রাম আজ পল্লী বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাগুলো পাকা হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন যুগের সৃষ্টি হয়েছে। খানসামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বিশ থেকে আজ পঞ্চাশ বেডে উন্নীত হয়েছে। উপজেলার স্কুল, কলেজগুলোতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে। নতুন করে বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে উঠছে অনেক স্কুল, কলেজ। তবে খানসামা-রানীরবন্দর সড়কটি প্রশস্ত না হওয়ায় উন্নয়ন তথা আধুনিকায়নে কিছুটা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

সাড়ে ৬০০ বছরের চেহেলগাজী মাজার, খানসামা

অপরদিকে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হলেও এখানে কোনো শিল্প কারখানা  গড়ে ওঠেনি। যার ফলে কৃষকরা তাদের কৃষজাত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত যখন শিল্প কারখানায় সমৃদ্ধ তখন অত্র উপজেলা শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অনেক  পিছিয়ে। এখানে কল-কারখানা স্থাপন করা হলে সাধারণ জনগণসহ শিক্ষিত-অল্প শিক্ষিত বেকার তাদের জীবনের মূল্য খুঁজে পেত। মাদক নামক অভিশাপ থেকে হয়তো রক্ষা পেত। যদিও বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন খানাসামাকে মাদকমুক্ত করতে এবং বাংলাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম বাসুলি গ্রামকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করেছেন। বাস্তবতা হলো খানসামা উপজেলার জীবনচিত্র বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেকাংশে পাল্টে গেছে। এ যেন আধুনিক জীবন ও সভ্যতার এক অবিরাম হাতছানি।

প্রতিক্ষণ/এডি/সাই

 

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G