টেলিভিশন সাংবাদিকতার কৌশল (পর্ব-৫): রাকিব হাসান

প্রকাশঃ এপ্রিল ৭, ২০১৫ সময়ঃ ৯:১৮ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৫:৩২ অপরাহ্ণ

tv-journalismযারা টেলিভিশন সাংবাদিকতা নিয়ে আগের তিনটি পর্ব পড়েছেন তারা হয়তো থিওরিটিক্যাল এবং প্রাকটিক্যালের সমন্বয় কিভাবে করতে হয় এ বিষয়ে মোটামুটি ধারণা পেয়েছেন। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে টেলিভিশন সাংবাদিকতায় ফিল্ড ওয়ার্কই মূলত শেখার অন্যতম জায়গা। কারণ ফিল্ড থেকেই নানা প্রতিকূলতা পার করেই কাঁচামাল (র‘মেটারিয়ালস) সংগ্রহ করতে হয়। এজন্যই বলা হয় রিপোর্টাররা হচ্ছেন কাঁচামালের যোগানদার। একেকটি রিপোর্টের পেছনের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোকপাত করলেই বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে———-

শুক্রবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হল। আমার এ্যাসাইনমেন্ট নারী বিষয়ক একটি সেমিনার। অনুষ্ঠানের যা ধরণ ঊভ সিংকের বেশি হবে বলে মনে হয়না। ভাবলাম এ নিউজটা দিয়ে জুম‘আর নামায পড়ে ফ্রি মুডে বাকী সময়টা অফিসে পার করব। এই ভেবে ক্যামেরাম্যানকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসলাম। সেমিনার মাত্র শুরু হলো, তখনই সেন্ট্রাল ডেস্কের ডেপুটি নিউজ এডিটরের ফোন- ‘ নারায়নগঞ্জের লাঙ্গল বন্ধে যেতে হবে। পূণ্যস্নান করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে সেখানে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।’ তৎক্ষণাৎ ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে হলরুম থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ীতে উঠলাম।

এবার চীফ রিপোর্টারের ফোন, ‘অনেক দূরের পথ.. গরম বেশি ..অফিসে এসে একটা এসি গাড়ী নিয়ে যান, আর সাথে টিভিউ নেন, লাইভ দিতে হবে।’ হঠাৎ এমন আ্যাসাইনমেন্টে ক্যামেরাম্যান হানিফ কিছুটা আহত হলো।

আমার মতো সে নিজেও হয়তো একটু ফ্রি মুডে থাকতে চেয়েছিলো। বিরক্ত হয়ে সে বলেই ফেলল.. ‘ অত দূর যেতে হবে, শালারা মরার আর টাইম পাইলো না’। টেলিভিশন সাংবাদিকদের রিজার্ভ ফোর্সের মতই তৈরি থাকতে হয়। এতসব ভাবলে হয়না, ঘটনা ঘটা মাত্রই ছুটে যেতে হয়। সুতরাং আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না।

এরই মধ্যে সেন্ট্রাল ডেস্ক থেকে এসএমএস করা হলো নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধির ফোন নম্বর। ফোনে প্রতিনিধির কাছ থেকে আপডেট জেনে অফিস থেকে গাড়ী পাল্টে বেরিয়ে পড়লাম নারায়ণগঞ্জের পথে। যেতে যেতে লাইভে কি বলব মাথার ভেতর সাজিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। সাইনবোর্ড পার হবার পর গাড়ীর চাকা পাংচার। ড্রাইভার নজরুল ভাই সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। কিছুই হচ্ছে না। অথচ অন্য স্টেশনের আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাইভ দিতে পারলেই পরিশ্রম স্বার্থক হতো। স্টেশনও তাই আশা করে।

বেশ কয়েকটি চ্যানেলের গাড়ী পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে আর মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর কড়া রোদ রাগের থার্মোমিটারকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। চ্যানেল নাইনের গাড়ী পাশ দিয়ে চলে গিয়ে আবার ফিরে এলো। রিপোর্টার ভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের পরিচিত ছোটভাই ইব্রাহিম। তার গাড়ীতে উঠতে বলল। দেরি না করে ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে যন্ত্রপাতিসহ ঐ গাড়ীতে ওঠে পড়লাম। আমাদের ড্রাইভারকে গাড়ী সারিয়ে গন্তব্যস্থলে আসতে বললাম। অনেক দূর যাবার পর মেইনরোড শেষ। এবার সোজা পশ্চিমে। আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে গাড়ী চলছে লাঙ্গলবন্দের উদ্দেশ্যে। এই জায়গার এমন অদ্ভুত নাম, কে রেখেছে.. এমন আলোচনা চলছিল সবার মধ্যে।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম। গাড়ী রেখে আরো আধা কি.মি. হাঁটা পথ। রোদের তীব্রতা উপেক্ষা করেই চ্যানেল নাইনের রিপোর্টার ক্যামেরাম্যানসহ আমরা চারজন ছুটছি সে পথে।
অবশেষে পৌঁছলাম লাঙ্গল বন্দের রাজঘাটে। ঘাটের পাশেই একটি মাছের আড়তের ফ্লোরে সারিবদ্ধ করে রাখা আছে ১০ টি লাশ। ৭ জন মহিলা আর ৩ জন পুরুষ। সবার বয়স ৫০ এর বেশি। লাশ ঘিরে স্বজনদের আহাজারিতে চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে ওঠছে। ক্যামেরাম্যানকে ছবি নিতে বললাম।

ছবি নেয়া শেষ হতে না হতেই খবর পেলাম নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ কমিশনার এসেছেন। ফুটেজ নিতে ক্যামেরাম্যান ততক্ষণে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজে বের করে বললাম, যেহেতু লাশ এখানে থাকবে সুতরাং লাশের ফুটেজ পরে,আগে জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ কমিশনারের সিংক নিতে হবে। তাদের বক্তব্য মিস করা যাবে না। শত শত মানুষ ঠেলে আমরা এলাম পাশের একটি স্কুল ঘরে, যেখানে জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ কমিশনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলছেন। আমার সাথে আরো কয়েকটি চ্যানেল ধাক্কাধাক্কি করে ঢুকলো ঐ ছোট্ট রুমটিতে। জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ কমিশনার আমাদের একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিলেন। যথারীতি এ ঘটনার জন্য দু:খ প্রকাশ এবং নিরাপত্তা বাড়ানোর আশ্বাস দিলেন তারা।

hinduকিন্তু কি ছিলো ঘটনাটি ? তা জানতে আবারো ছুটলাম নিহতের স্বজনদের কাছে। সারিবদ্ধ লাশের পাশে বসে কান্না করছিলো অনেকে। এদের একজন স্বামীর লাশ ধরে বিলাপ করছেন। কপালের সিঁদুর লেপ্টে গেছে তার। ক্যামেরাম্যান তার অশ্রæসজল চোখের শট নিচ্ছেন। মাইক্রোফোনটা তার সামনে ধরে ক্যামেরাম্যানকে সংকেত দিলাম বক্তব্য ধারণ করতে। কাঁদতে কাঁদতে ঐ মহিলা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ঐ অবস্থায় কয়েকটি মাছি এসে বার বার ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে বিরক্ত করছে আমাকে আর আমার ক্যামেরাম্যানকে। দেখলাম লাশের গায়ের মাছিগুলো বার বার আমাদের গায়ে এসে বসছে, কেমন বিদঘুটে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। লাশের গায়ের মাছি আমাদের গায়ে ..ভাবতেই খুব অস্বস্তি লাগছিলো। মনোযোগ ছুটে যাচ্ছিলো বারবার। এসব দেখে এই মহিলাকে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো না। ভদ্রমহিলা যা বললেন তার সারাংশ হচ্ছে- ‘হাজার হাজার মানুষ রাজঘাটের দিকে পূন্যস্নানের জন্য যাচ্ছিল। হঠাৎ কে যেন চিৎকার করলো পাশের স্টিলের ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ছে। এই সংবাদে ব্রিজের মুখে যারা ছিলো তারা পেছন দিকে দৌঁড় দিলো। তাদের দেখে হাজার হাজার মানুষ না বুঝেই যে যার মত ছুট দিল। সেই দৌঁড় চলল টানা ২৫ মিনিট ধরে। পায়ের নিচে পড়ে গেল শত শত মানুষ। যারা বয়সে তরুণ-শক্ত সামর্থ তারা কোনমতে ওঠে দাড়ালেও বয়স্ক এবং দুর্বলরা ওঠে দাঁড়াতে পারেনি। পদদলিত হয়েই প্রাণ গেছে তাদেরই। আহত হলো আরো জনা-পঞ্চাশেক।’

একজনের বক্তব্যে তো নিউজ স্টাবলিশ করা যায়না। প্রত্যক্ষদর্শী আরো কয়েকজনের বক্তব্য নিলাম। ততক্ষণে প্রডিউসারের ফোন, ‘ভাই ১টার নিউজে লাইভ যাবে, আপনারা প্রস্তুত হোন। টিভিউ অন করেন।’ শত শত মানুষকে দু-হাতে সরিয়ে সারিবদ্ধ লাশের কাছেই একটা উচু সিঁড়ির ওপর আমি আর ক্যামেরাম্যান দাঁড়ালাম। টিভিউ অন করা হলো। কিন্তু বিশ মিনিট চেষ্টার পরও অফিসের সাথে এ যন্ত্রটির সংযোগ হলোনা। প্রচন্ড গরমে আমি আর কামেরাম্যান ততক্ষণে ঘেমে অস্থির। ফোনে নিউজ প্রডিউসারকে বললাম, বাদ দেন, ফ্রিকোয়েন্সি কাজ না করলে আর বৃথা সময় নষ্ট করে লাভ কি ?

এবার ছুটলাম রাজঘাটে। যেখানে স্নান করতে গিয়ে এতকিছু। সে জায়গার ফুটেজ নিতেই হবে। রাজঘাটে আরো কিছু মানুষের সাথে কথা বলতে হবে, ব্রিজের ছবি নিতে হবে, বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলের ছবি দিয়ে ঘটনাস্থলটি ফুটিয়ে তুলতে হবে। ক্যামেরাম্যানকে এসব দিক-নির্দেশনা দিচ্ছিলাম।

যেতে যেতে পথে দেখলাম চবি সাংবাদিকতা বিভাগের ছোটভাই একাত্তর টিভির রিপোর্টার কাওসার লাইভ দিচ্ছে, পুরো বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। অথচ আমার টিভিউ যন্ত্রটি কাজ করছে না, গুরুত্বপূর্ণ এ লাইভটি আমি দেখাতে পারছি না। ইচ্ছে হলো যন্ত্রটাকে আঁছাড় মারি। কিন্তু সাংবাদিকদের এসব ইমোশন থাকতে নেই, সাংবাদিকরা পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। মনকে এসব বুঝালাম।

আরো কি কি ধরণের শট লাগবে ক্যামেরাম্যানকে বুঝিয়ে দিলাম। চ্যানেলের সবচেয়ে অদক্ষ ক্যামেরাম্যানটি আমার সাথে। তাই ভাবনাটাও একটু বেশি। প্যানেলে গিয়ে সব ছবি ঠিকমত পাব কিনা বুঝতে পারছিনা।

যাহোক, নির্দেশনা মতো রাজঘাটে নেমে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা ও স্নানের কিছু শট নেয়া হল। ততক্ষণে বেলা আড়াইটা । ৫ টার নিউজ ধরাতে হলে এখনই ফেরা দরকার। অতএব শুটিং শেষ।

আবারো আধা কিলো হেটে মেইনরোডে এলাম। এসে দেখি আমাদের পাইলট নজরুল ভাই অপেক্ষা করছেন। গাড়ি সারিয়ে তার মুখে রাজ্যজয়ের হাসি। কিন্তু আমরা যে লাইভ মিস করলাম সেটাতো আমরাই বুঝি। যাহোক, এবার ফেরার পালা। স্ক্রিপ্ট কি লিখব গাড়ীতেই কিছুটা টুকে নিলাম। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে আসাতে অনেকটা সময় বেঁচে গেল। প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে ঢাকায় চলে এলাম। টিএসসির পাশ দিয়ে যেতে দেখি এক লোক লেবুর শরবত বিক্রি করছে। এটা দেখে ক্যামেরাম্যানের গলা শুকিয়ে গেলো। বাধ্য হয়ে তিনজনই গলা ভেজালাম। সামান্য লেবুর শরবতকে অমৃত মনে হচ্ছিল। অফিসে এসে স্ক্রিপ্ট লিখে ডিএনইকে দেখালাম।

ততক্ষণে নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি স্থানীয় এমপির বক্তব্য এফটিপিতে পাঠালো। আমার স্টোরিতে এটা সংযুক্ত করতে বললেন ডিএনই। এরপর কিছু এডিট করে তিনি প্রিন্ট দিলেন। আমি ভয়েস রুমে গিয়ে ভয়েস দিয়ে যখন প্যানেলে ঢুকলাম তখন বিকেল ৪.৩০। ভিডিও এডিটরকে সব বুঝিয়ে দিয়ে শব্দ এবং ছবির সমন্বয় করে প্যাকেজ দাঁড় করলাম। ততক্ষণে ৪.৫৯। ৫টার নিউজ শুরু হতে ১ মিনিট বাকী। আমারটাই লীড নিউজ। প্রডিউসার জিল্লুর ভাই উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এলেন- ভাই কি অবস্থা? বললাম নো টেনশন। নিউজ পাইপ লাইনে। প্রেজেন্টার শিরোনাম পড়া শুরু করলো। আর আমার নিউজও সেন্ট হলো প্রডিউসারদের ভিটিতে। নিউজরুমে এসে টেলিভিশনে চোখ রাখলাম। ৫টার খবরে প্রথমেই যাচ্ছে আমার নিউজ।

দ্রুততার সাথে করলেও স্টোরিটা যেভাবে চেয়েছি সেভাবেই করতে পেরেছি। ৭টার.. ৯টার নিউজ দেখা হয়নি। ১১টার নিউজ দেখলাম। তখনও আমার নিউজটাই লিড। দেখে মনে হলো পরিশ্রম স্বার্থক। একটি দিনের ২ মিনিটের একটি প্যাকেজ আর তার জন্য কত দৌঁড়ঝাপ হলো। এটাই হচ্ছে মূলত টেলিভিশন সাংবাদিকতা। পরদিন হয়তো আবারো ছুটতে হবে এরকমই কোন খবরের সন্ধানে। সে অভিজ্ঞতা যেমন বিনিময় হবে ঠিক তেমনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়েও পর্যায়ক্রমে আলোচনা হবে পরবর্তী পর্বগুলোতে।

রাকিব হাসান
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল: [email protected]

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G