প্রকৃতির মাঝে নৃশংসতার নাম দিয়াগো গার্সিয়া

প্রকাশঃ জানুয়ারি ২৬, ২০১৫ সময়ঃ ১২:৩৪ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:৪৬ অপরাহ্ণ

ডেস্ক রিপোর্ট, প্রতিক্ষণ ডটকম:

3780_2মনোরম একটা দ্বীপ। অথচ তাকে বলা হয় প্রাচ্যের গুয়ান্তানামো । নাম শুনলেই যেন বুক মোচড় দিয়ে ওঠে, ভয়াবহতার কথা মনে পড়ে।

কিন্তু তার সাথেও সখ্য আছে প্রকৃতির। প্রকৃতি মানুষকে যেমন ভালোবাসে আবার গ্রাসও করে নেয়, উত্তাপ যেমন ছড়ায় তেমনি শীতলও করে দেয় সবকিছুকে।

দেখতে পায়ের পাতার মতো। মনে হবে সাগরের ওপর দিয়ে কেউ হেঁটে যাওয়ায় ছাপ লেগে গেছে ।

তেমনি একটা প্রবাল দ্বীপ যার নাম দিয়াগো গার্সিয়া।

এর অবস্থান ভারত মহাসাগরের মাঝখানে, পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার নাক বরাবর।

কিউবার সেই কুখ্যাত গুয়ান্তামো বে কারাগারের সাথে তুলনা করা হয় একে। গুয়ান্তানামোর মতোই এখানেও একটি কারাগার আছে। এ কারাগারও নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিনিরা। সেই ১৯৬৬ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে দ্বীপটি ইজারা নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তখনই তারা সেটিকে বিশাল সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করে। তারপর থেকে ৪৯ বছর চলে গেছে। বলা হয়, সারা দুনিয়াই সাংবাদিকদের জন্য খোলা। কিন্তু এই একটি স্থান আছে, যেখানে প্রায় অর্ধশতক ধরে সাংবাদিকদের যাওয়া নিষিদ্ধ।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র সংবিধানে বর্ণিত উন্মুক্ততা এবং কথা বলার স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে যথেষ্ট কঠোরতার মধ্যে হলেও গুয়ান্তানামোতে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের প্রবেশের সুযোগ দেয়। কিন্তু দিয়াগো গার্সিয়ার কোনো প্রকাশ্য ফটো নেই, কেবল অনেক উঁচু দিয়ে যাওয়া বিমানের ছবি ছাড়া।

সাড়ে ৬০০-এর বেশি কংক্রিটের ভবনে পূর্ণ দিয়াগো গার্র্সিয়াকে আমেরিকানরা গোলকধাঁধায় ভরা একটা ছোট নগরীতে পরিণত করে ফেলেছে। এর কাঠামো অনেকটাই গুয়ান্তানামো বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ভয়াবহ সুন্দর ভুখণ্ডের কেন জিনিসটি তারা লুকাতে চায়? অথচ নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো, মার্কিন নৌবাহিনী স্থানটির নতুন নামকরণ করেছে ‘ফুটপ্রিন্ট টু ফ্রিডম।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম দিককার কথা এসে যায়। ওই সময়ে ব্রিটেনে ক্ষমতায় ছিল টনি ব্লেয়ার সরকার। ব্রিটিশ সরকার বেশ কৌশলের সাথে ওই সময়ে ব্রিটিশ ভূখণ্ড ব্যবহার করে বন্দীদের পারাপার এবং দিয়াগো গার্সিয়া এবং অন্যান্য প্রত্যন্ত এলাকায় বন্দী হস্তান্তর ও জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ করে দিয়েছিল।

দিয়াগো গার্সিয়াকে যে অন্যায় কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সে সন্দেহ সেই ২০০৫ সালে উঠেছিল। ওই সময়ের ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র দিয়াগো গার্সিয়াকে বন্দী স্থানান্তর বা নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এটা স্রেফ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অংশবিশেষ। এখন প্রমাণিত হচ্ছে, তিনি এবং তার মার্কিন প্রতিপক্ষ কন্ডালিৎসা রাইস মিথ্যা বলেছিলেন।

ওই ঘটনার দুই বছর পর প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ দিকে টনি ব্লেয়ার ঘোষণা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনো কোনো বন্দী হস্তান্তরে ব্রিটিশ ভূখণ্ড ব্যবহার না করায় তিনি সন্তুষ্ট। তার বিদায়ের দুই বছর পর মানবাধিকার গ্রুপগুলো সন্দেহাতীত প্রমাণ উপস্থাপন করে যে, দিয়াগো গার্সিয়ায় কথিত সন্ত্রাসে জড়িত বন্দী হস্তান্তর হয়েছিল। ফলে ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার পূর্বসূরি জাতিকে বিভ্রান্ত করেছিল।

যাদের সেখানে আটক রাখা হয়েছিল, তাদের কথাও শুনতে হয়। এটা ঠিক যে, তাদের পক্ষে স্থানটি নির্ধারণ করা কষ্টকর। যেসব অন্ধ কুঠুরীতে তাদের নির্মম সব পন্থায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো, তারা যাতে সেখানকার কথা বলতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের নিয়ে যাওয়ার সময় এক দিকে তাদের চোখ বাঁধা থাকত, সেই সাথে কানে পরানো হতো সাউন্ডপ্রুফ সরঞ্জাম।
কিন্তু তারপরও কোনো কোনো বন্দী ভুতুড়ে কারা-জাহাজের পাটাতনের নিচে অবস্থানকালে দিয়াগো গার্সিয়ার কোনো স্থানে নোঙর করার বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন।

তথাকথিত আমেরিকান তালেবান জন ওয়াকার লিন্ধের কাছ থেকেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইসলামে ধর্মান্তরিত জনকে ২০০১ সালে আফগানিস্তান থেকে আটক করা হয়। তাকে দিয়াগো গার্সিয়ার নৌঘাঁটিতে থাকা ইউএসএস বাতানে আটক রাখা হয়েছিল।

দিয়াগো গার্সিয়াকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে সেখানে বিমান ওঠা-নামার লগবুক।
তবে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে খোঁড়া অজুহাত দাঁড় করিয়েছে, তাতে সন্দেহ বরং আরো বেড়েছে। যে সময়টাতে বন্দীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, ওই সময়কার নথিপত্র নষ্ট হয়ে গেছে বলে দাবি করছে তারা। তাদের ভাষ্য, চলতি বছরের জুনে যে ভবনে নথিপত্র রাখা ছিল, তাতে ফাটল ধরে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করেছিল।

এসব ঘটনা যখন ফাঁস হচ্ছে, তা ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছেই গোদের ওপর বিষফোঁড়া বিবেচিত হচ্ছে। ব্রিটেনের কাছ থেকে দ্বীপটি ৫০ বছরের জন্য লিজ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে এ জন্য ব্রিটেনের কাছে পলারিস পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা বিক্রি থেকে পাওয়া ১৩ মিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছিল। ২০১৬ সালে ওই লিজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
তবে চুক্তিতে দুটি ফাঁক রাখা হয়েছে। তা হলো দুই দেশ লিজের মেয়াদ আরো ২০ বছর বাড়ানো নিয়ে আলোচনা করবে, কিংবা ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বর্তমান ব্রিটিশ সরকার সম্ভবত চায়, আমেরিকানরা সেখানে থেকে যাক।তবে ছাগোস আইল্যান্ডসের অধিবাসীরা কিন্তু বাপ-দাদার ভিটায় ফিরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা তাদের অর্ধশতাব্দীকালের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটাতে চায়।

তাদেরকে যে নৃশংস পন্থায় সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকায় তেমন হইচই হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, সেটা সাম্প্রতিক ব্রিটিশ ইতিহাসের আরেকটি লজ্জাজনক ঘটনা হতে পারে। এসব লোকের একটি অংশকে নেয়া হয়েছিল আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস হিসেবে, ১৯ শতকের শেষ দিকে। তাদেরকে নারকেল বাগানে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

অ্যালেন ভিনকেটাসিনের বয়স এখন ৪৪ বছর। তাকে তাদের কংক্রিটের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় তার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। আরো অনেক পরিবারের মতো তারটিও ওই অভিযানে গুঁড়িয়ে যায়। তার মা ও বাবা তখনো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি, তারা তখনো ছিলেন কিশোর-কিশোরী (দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপে খুব অল্প বয়সে সন্তান লাভ ছিল অতি সাধারণ ঘটনা)। উচ্ছেদের সময় তাদেরকে আলাদা আলাদা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়।
অ্যালেন ছিলেন তার দাদা-দাদীর সাথে মরিশাসে। সেখানে তাদেরকে কর্দপশূন্য অবস্থায় ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। দেহে যে পোশাকটা ছিল সেটাই ছিল সম্বল। অ্যালেন তার মাকে আবার দেখতে পেয়েছিলেন ১৭ বছর পর।

এই দাবি গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যদি দিয়াগো গার্সিয়াকে যে গোপনীয়তার আবরণে ঢেকে রাখা হয়েছে, তা ছিঁড়ে ফেলা হয়। যতদিন অন্ধকার থাকবে, যতদিন নিষেধাজ্ঞার বেড়া থাকবে, ততদিন প্রত্যন্ত এই স্বর্গটিকে ঘিরে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক থেকেই থাকবে।

 

প্রতিক্ষণ/এডি/আকিদুল ইসলাম

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G