মানুষের কিডনি নিয়ে অমানুষের ব্যবসা

প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৫ সময়ঃ ২:২৩ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ২:২৩ অপরাহ্ণ

makসৃষ্টি জগতের মধ্যে মানুষের মর্যাদা বেশি। কারণ তার বিবেক। দুনিয়ায় যারা বিবেকবান, পরকালে তাদেরই বিচার হবে। আর মনুষ্যত্ববোধ ও মানবীয়গুণাবলীর উপস্থিতির কারণেই আমরা মানুষ। মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে কেউ উত্তম আর কেউ অধম। বিবেক ও মানবীয় গুণাবলী ব্যতীত লোকটি দৈহিক কাঠামোর কারণে মানুষ পরিচয় পেলেও কুরআনুল কারীমে তাকে চতুষ্পদ জন্তু কিংবা তার চেয়েও নিকৃষ্ট প্রাণীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। আমরা কি ভেবে দেখেছি, আমরা সৃষ্টির সেরা হলেও আমাদের কাজগুলো সুন্দর হচ্ছে কি না? হয়তো ভাবিনা। গত কয়েকদিন ধরে আলোচিত হচ্ছিল, “কিডনি পাচার চক্রের ৫ সদস্য গ্রেফতার তিন দিনের রিমান্ডে”(নয়া দিগন্ত:৩০ আগস্ট ’১৫)। “কিডনি কেটে নিয়ে লাশ ফেলা হয় নদীতে (কালেরকণ্ঠ সম্পাদকীয়:৩০আগস্ট ’১৫)। “কিডনি পাচার চক্রে চিকিৎসকও জড়িত”(সমকাল: ৩১ আগস্ট ’১৫)। “কিডনি পাচার : ঢাকা কেরানিগঞ্জ সাভারের অর্ধডজন ডাক্তার জড়িত”। “মানুষের কিডনি-লিভার ও চোখ বেচাকেনা হয় হাসপাতালে”। “একটি কিডনি বিক্রি হয় ৪ থেকে ৬ লাখ টাকায়।” এভাবেই গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে এ সম্পর্কীত বিভিন্ন দিক প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে।

মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য উপার্জন করতে হয়, তাই বলে অপর ভাইয়ের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিংবা শরীরের এক বা একাধিক অংশ বিক্রি করে অর্থাপার্জন করতে হবে? একজন মানুষ একই নিচু হতে পারে! এসব পেশা ও প্রতারণার সাথে যারা জড়িত তারা সামান্য কিছু টাকার জন্য এত নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য কাজগুলো করছে! তাদের বিবেক সামান্যতম বাঁধা দিলো না? প্রয়োজনের তাগিদে উপার্জন করতে হবে তাই বলে একজন মানুষ এভাবে নিকৃষ্ট-জঘন্য অপরাধ করবে এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। জানা যায়, কেউ কেউ ক্ষুধার তাড়নায় সামান্য টাকার বিনিময়ে কিডনি বিক্রি করতে রাজি হয়ে যান। এটি অস্বাভাবিক একটি বর্ণনা। দারিদ্রতার কষ্ট যতই হোক, চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে কেউ কিডনি বিক্রি করার কথা বলেছেন এমনটি এখনো পর্যন্ত শোনা যায় নি। এ থেকে বুঝা যায় দারিদ্রতার কারনেই কিডনি বিক্রি করছেন এমনটি মনে হয় না। কেউ অতিলোভে পড়ে, কেউ আবার অজ্ঞতার কারণে, কেউবা প্রতারক চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবন হারাচ্ছেন। টাকার লোভে হোক বা প্রতারণার শিকার হোক, শরীরের কোন অংশ বা অঙ্গ বিক্রির চিন্তা করা বা বিক্রি করা কিংবা এসব ব্যাপারে কাউকে পরামর্শ ও উৎসাহ দেয়া মহা অন্যায়। যারা জেনে-শুনে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে অর্থের লোভ দেখিয়ে কিডনি কিংবা শরীরের অন্য কোন অংঙ্গ বা অংশ বিক্রির মতো অপকর্ম করছেন তাদের বহুগুণে শাস্তি হওয়া উচিত। ব্যবসার নামে এই ধরণের অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ। প্রতারক চক্রের সাথে প্রকৃতভাবে যারা জড়িত তাদের নগদ অর্থের বিনিময়ে কিংবা নাম মাত্র বিচারের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হলে একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।

আন্তর্জাতিক কিডনি পাচার চক্রের সাথে দেশীয় কতিপয় চিকিৎসকদের জড়িত থাকার কথা জানা গেছে। যখনই সেবামূলক কোন পেশার কথা আমরা শুনি তখনই চিকিৎসকদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সম্প্রতি একশ্রেণির চিকিৎসক ব্যবসায়িক মানসিকতা লালন করায় চিকিৎসা সেবা না বলে চিকিৎসা বাণিজ্য বলাই যুক্তিযুক্ত হয়ে পড়ছে। প্রতারক চক্র যেসব চিকিৎসকদের সহযোগীতা নিয়ে কিডনি পাচার করছে তাদেরকেও গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা উচিত। কেননা, চিকিৎসকরা সহযোগীতা না করলে তারা অপারেশন করতে পারে না। তাই এদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা না গেলে আরও বহু মানুষ প্রতারণার শিকার হবেন। প্রতারক চক্রটি ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে নিজেদের কিডনি বিক্রি করে সহজেই সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, কিডনি বিক্রি করলেও তার শরীরের কোন ক্ষতি হবে না। যারা কলকাতার ফরটিজ হাসপাতালে গিয়ে কিডনি ট্রান্সফার করেন তাদেরকে বেশি টাকা প্রদান করা হয়। কেউ আবার দেশীয় হাসপাতালগুলোতে সামান্য টাকায় কিডনি ট্রান্সফার করে থাকেন বলে থাকে বলে জানা গেছে। বিশেষকরে প্রতিটি কিডনি হসপিটলের সামনে দালাল চক্রের সদস্যরা বিচ্ছিন্নভাবে ঘোরাফেরা করেন, কৌশলে তারা কিডনি কেনা-বেচার মধ্যস্থতা করেন। কিডনি ট্রান্সফারের পর যেসব ভিকটিমরা মারা যান তাদেরকে নদীতে ফেলে দেয়ার পরিকল্পনার কথাও স্বীকার করেছেন প্রতাররক চক্রের হোতা আবদুল জলিল। চিকিৎকরা মনে করেন, কিডনি পাচার করা যায় না। কেননা, কিডনি সংরক্ষণের কোন প্রযুক্তিও আবিষ্কার হয়নি। তবে এ উদ্দেশ্যে অধিকাংশ সময়ে মানুষ পাচার করা হয়।

যদি কারো দু’টো কিডনিই বিকল হয়ে যায়, তাকে বাঁচানোর জন্য তার নিকটতম আত্মীয়দেরই এগিয়ে আসা উচিত। আর কিডনি ট্র্রান্সফারের জন্য কিডনি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদেররর পরামর্শ নেয়াইা সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে হয়। দেশেই সফলভাবে কিডনি ট্রান্সফারের ব্যবস্থা রয়েছে, তাই আন্তর্জাতিক কোন চক্রান্তের শিকার হয়ে দেশীয় সুনামকে বাঁধা সৃষ্টি না করা হয় সে দিকে খেয়াল রাখা দরকার।
বিশ্বের ১৫৭ টি দেশে প্রতি বছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব কিডনি দিবস পালন করা হলেও আমাদের দেশে সাধারণের মাঝে যথাযথভাবে দিবস পালনের যথার্থতা ফুটে ওঠে না। বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্য মতে, দেশে প্রতি ঘন্টায় ৫ জন মারা যাচ্ছে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে। (সময় নিউজ, ১২.০৩.’১৫)। অপর এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে দুই কোটি লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তাই আমাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রত্যেকেরই সচেতন হওয়া জরুরী। বিশেষকরে-প্রসাব আটকে রাখা, পর্যাপ্ত পানি পান না করা, অতিরিক্ত লবন খাওয়া, যেকোন সংক্রমণের দ্রুত চিকিৎসা না করা, প্রয়োজনের তুলনায় কম খাওয়া, অপরিমিত ব্যথার ওষুধ সেবন, ওষুধ সেবনে অনিয়ম, অতিরিক্ত মদ খাওয়া ইত্যাদি। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।

সর্বোপরি, সাধারণ মানুষকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। কিডনি ক্রয়ের প্রতারক চক্রের হাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য জনসচতনতা বৃদ্ধিতে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া উচিত। বিশেষকরে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারসহ মসজিদ-মন্দির অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাইকিং ও পোস্টার সাঁটানোর মাধ্যমে গণসচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে।
লেখক :
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
শিক্ষক ও কলামিস্ট

এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G