যশোরের ঐতিহ্যবাহী চিরুনি শিল্প

প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৫ সময়ঃ ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:১৮ অপরাহ্ণ

নিজেস্ব প্রতিবেদক

chiruni shilpoযশোর নামের সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক ঐতিহ্য। তারই মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্যর নাম হল চিরুনি শিল্প। বঙ্গ ললনাদের মেঘবরণ চুলের চর্চায় অন্যতম ছিলো যশোরের চিরুনি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এক সময় এই চিরুনির সাড়া জাগানো সুনাম ছিলো অখন্ড ভারত উপমহাদেশ জুড়ে। সে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল শ্রীলংকা, মিশরসহ সমগ্র আরব দেশে। বিভিন্ন প্রদর্শনীতে যশোরের চিরুনি অর্জন করেছে স্বর্ণপদক। বলতে গেলে উপমহাদেশের বাজার তখন ঝুঁকে পড়েছিলো যশোরের চিরুনির দিকে।

যশোরের হাড়ের চিরুনি পৃথিবী খ্যাত। প্রকৃত পক্ষে হাড়ের চিরুনি যশোরে কোন দিনও তৈরি হতো না। জানা যায়, ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মহিষের সিং থেকে চমৎকার চিরুনি তৈরি হতো। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারত থেকে মহিষের সিং আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে শুধু সেলুলয়েডের চিরুনীই যশোরে তৈরি হয়। আমাদের দেশের মহিষের সিং উন্নতমানের না হওয়ায় এবং এ থেকে উন্নত মানের চিরুনি তৈরি না হওয়ায় সিং থেকে চিরুনি তৈরিতে ভাটা পড়ে।

১৯০১ সালে ‘কম্বস এন্ড সেলুলয়েড ওয়ার্কস’ নাম দিয়ে চিরুনি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। মাত্র ৪০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি চালু করা হয়। প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তা ছিলেন শ্রী কিরণ দত্ত, মন্মোথ বাবু এবং শ্রী মিত্র। এদের মধ্যে মন্মোথ বাবু চিরুনি শিল্পের উপর জাপান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে বৃটিশ ও পাকিস্থান আমল মিলিয়ে আরো তিনটি চিরুনি শিল্পের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে যশোরের চিরুনির সুনাম আস্তে আস্তে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন দৈনিক পঁচিশ হাজার চিরুনি এই কারখানায় তৈরি হতো। এই সময়ে মহীশূর, কোলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বে, হায়দরাবাদ, কানপুর, লাহোর, দিল্লী, করাচী, লাক্ষ্ণৌ, আহমেদাবাদ, মিরাট, পুনে, বরোদা, পাটনা সহ বলতে গেলে প্রায় সারা ভারত জুড়েই চলতে থাকে প্রদর্শনী।

chiruni2হাতে অথবা মেশিনে দু’ভাবে চিরুনি তৈরি করা যায়। এর মান নির্ভর করে সম্পূর্ণ কারিগরের দক্ষতার উপর। প্রথমে সেলুলয়েড সিট ডিজাইন মতো কেটে নেওয়া হতো। এরপর এগুলো ফালি করে এগুলো চিরুনির আকারে আনা হতো। ফালি করার কায়দা এবং দক্ষতার উপর নির্ভর করে চিরুনির রং। এক এক ভাবে ফালি করলে এক এক ধরনের রং বের হতো। এরপর পালিশ করে মসৃণতা এবং রঙের উজ্জ্বলতা আনা হতো। তখন দাঁত ফিনিশিং করলে তৈরি হতো সুদৃশ্য চিরুনি।

চিরুনি ফ্যাক্টিরির জন্য যন্ত্রপাতি লাগতো সামন্যই। কাটিং, এবং দাঁত কাট মেশিন যা যে কোন রকম লেদ ওয়ার্কশপ থেকে তৈরি করা যেত। যশোর ছাড়া এধরনের চিরুনির আরো দুইটি কারখানা ছিলো ‘জেসকো কম্ব ফ্যাক্টরি’ নামে খুলনাতে এবং অন্যটি ‘ডাকো কম্ব ফ্যাক্টরি’ নামে ঢাকাতে। ঢাকার কারখানাটি ১৯৭২ সালে এবং খুলনারটি ১৯৭৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

সেই ঐতিহ্যবাহী যশোরের চিরুনি শিল্প আজ হারিয়ে গেছে। হাজারো রকমের সমস্যার কারনে এক সময় বন্ধ হয়ে যায় চিরুনি কল গুলো। চিরুনির কাঁচামাল তথা সেলুলয়েডের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং চোরাপথে আনা ভারতীয় চিরুনি এই শিল্পের নড়বড়ে ভিতকে আরো নড়িয়ে দেয়।

যশোরের চিরুনি শিল্পের ধ্বসের অন্যতম কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে সেলুলয়েডের অসম্ভব রকম মূল্য বৃদ্ধি। পাকিস্থান আমলে এক কিলোগ্রাম সেলুলয়েডের মূল্য ছিলো মাত্র ১০ টাকা। বাড়তে বাড়তে ১৯৮০ সালে তার মূল্য দাড়ায় ২০০ টাকায়। এর উপরে রয়েছে উৎপাদন খরচ, ব্যাংকের সুদ, বিক্রয় কর, আমদানি কর, আবগারি শুল্ক প্রভৃতির ধাক্কা। এই অস্বাভাবিক চারেপ মুখে প্রতিষ্ঠান গুলো একের পর এক বন্ধ হতে থাকে।

দেশত্যাগী যশোরের চিরুনি নির্মাতারা ভারতের বনগাঁয় এই শিল্প গড়ে তোলে। এবং প্রসার ঘটতে ঘটতে সেখানে ২৫০ টির বেশি কারখানা গড়ে ওঠে। এবং সহজেই বিপুল পরিমান চিরুনি রাতের আঁধারে সীমান্ত অতিক্রম করে চোরাচালানিদের ম্যাধ্যমে যশোর সহ বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায় যশোরের ঐতিহ্যবাহী চিরুনি শিল্প।

 

 

 

প্রতিক্ষন/এডমি/এফজে

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G