কোন পথে টেলিভিশন সাংবাদিকতা : প্রসঙ্গ লাইভ-এজ লাইভ(পর্ব-৪)

প্রকাশঃ এপ্রিল ২৪, ২০১৫ সময়ঃ ৩:১৫ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:৪২ অপরাহ্ণ

https://www.protikhon.com/wp-content/uploads/2015/04/tv-journalism1.jpg

টেলিভিশন সাংবাদিকতায় লাইভ এবং এজলাইভের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিশেষ-বিশেষ সময়ে সংবাদে লাইভ দেখানোর হিড়িক পড়ে যায়। বিশেষ কোন ঘটনা ঘটলে কে কার আগে কতবার, কতভাবে লাইভ দেবে এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় চ্যানেলগুলোর মধ্যে। প্রতিযোগিতার এই দৌঁড়ে ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলগুলো সবার আগে। ব্যাকপ্যাক, টিভিইউর কল্যাণে যেকোন সময় যেকোন স্থান থেকে খুব সহজেই লাইভ সম্প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে সব কিছু অর্থাৎ সব ঘটনাই লাইভ করার প্রয়োজন আছে কিনা ? আর সব লাইভের প্রতি দর্শক আগ্রহ আছে কিনা ? এ প্রসঙ্গে পরে আসছি, তার আগে যারা টেলিভিশন সংশ্লিষ্ট নন তাদের উদ্দেশ্যে লাইভ এবং এজলাইভ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া যাক।

khaleda gari
খালেদা জিয়ার গাড়ী বহরে হামলার দৃশ্য

লাইভ (Live) : লাইভ মানে জীবন্ত। যা পূর্বে ধারণকৃত নয়। এখনই ঘটছে এখনই দেখাচ্ছি। সাধারণভাবে টেলিভিশনে সরাসরি কোন কিছু সম্প্রচার করা হলেই আমরা বলি লাইভ। আরেকটু বিস্তৃতভাবে বললে, ‘ ঘটনাস্থল থেকে যখন কোন প্রতিবেদক সরাসরি ঐ ঘটনার বিবরণ, তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন অথবা প্রত্যক্ষদর্শী বা ভুক্তভোগীদের বক্তব্য সরাসরি টেলিভিশনে প্রচার করেন তখন সেটাকে লাইভ বলা হয়।’ এক্ষেত্রে ঐ ঘটনার বিষয়ে সরাসরি সংবাদ উপস্থাপক প্রতিবেদককে প্রশ্ন করে সর্বশেষ তথ্য জানতে চান। প্রতিবেদক সে প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রতিবেদক যদি উপস্থিত না থাকেন তাহলে চ্যানেলের স্টুডিও থেকে বসে সংবাদ উপস্থাপক নিজেই ধারা বর্ণনা দিয়ে থাকেন।’

ঠিক একইভাবে কোন সভা সমাবেশ অথবা খেলা যখন সরাসরি সম্প্রচার করা হয় সেটাও লাইভ।

এজ লাইভ (As live) : লাইভের মতোই কিন্তু লাইভ না। টেকনিক্যাল বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে লাইভ প্রচার সম্ভব না হলে প্রায় সময় লাইভের মতো করে রিপোর্টারের বক্তব্যটি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। ঘটনাস্থলে রানার পাঠিয়ে তার বক্তব্যটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয়, এরপর খবরে লাইভ হিসেবে সম্প্রচার করা হয়। সংবাদ উপস্থাপক হয়তো বলছেন এই মুহূর্তে বাংলামোটর থেকে খালেদার গাড়ী বহরে হামলার বিষয়ে জানাচ্ছেন আমাদের রিপোর্টার…। রিপোর্টার হয়তো ততক্ষণে ঘটনাস্থলে নেই। কিন্তু পূর্বে ধারণকৃত রিপোর্টারের বক্তব্য উপস্থাপন দেখে দর্শকের মনে হবে রিপোর্টার ঘটনাস্থল থেকেই বলছেন। এটাই হচ্ছে এজ লাইভ। এজ লাইভে রিপোর্টারকে প্রশ্ন করা হয়না। কারণ দর্শক না জানলেও অন্তত সংবাদ উপস্থাপক এবং প্রডিউসার জানেন বিষয়টি ধারণকৃত। উপরের বিষয়টি থেকে এটি স্পষ্ট যে সব লাইভ-ই লাইভ না

TVJn 5মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। কোনটা লাইভ হবে আর কোনটা হবে না , লাইভে কোন বিষয় বলা যাবে, আর কোন বিষয় বলা যাবে না এসব বিষয়ে  সুস্পষ্ট বিধি-বিধান থাকা উচিত। কোন নিয়মনীতি মানার বাধ্যবাধকতা নেই বলে গুরুত্বহীন বিষয়কে অহেতুক লাইভে নিয়ে এসে লাইভকেও গুরুত্বহীন করে দেয়া হচ্ছে।

একজন সাংবাদিক এবং একই সাথে সচেতন দর্শক হিসেবে আমি মনে করি সব ঘটনা লাইভ দেখানোর প্রয়োজন নেই। ঘটনার গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করেই লাইভ দেয়া উচিত। প্রযুক্তির সুবিধা আছে বলেই গুরুত্বহীন বিষয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় লাইভ দেয়াটা অনর্থক। দু:খজনক হলেও সত্য, কয়েকটি ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেল তাই করে আসছে। গুরুত্ব থাক বা না থাক লাইভ যেন দিতেই হবে। এই অদ্ভুত প্রতিযোগিতাই যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব প্রতিযোগিতা নিয়ে রয়েছে অদ্ভুত ও মজার কিছু অভিজ্ঞতা। এই পর্বে পাঠকদের জন্য সে বিষয়গুলো তুলে ধরছি।

বছর তিনেক আগের ঘটনা। তখন অন্য একটি চ্যানেলে কাজ করি। নিউজ এডিটর বললো বাংলা মোটরের পাশেই পান্থকুঞ্জ পার্কে যেতে। সেখানে ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে, কোন চ্যানেল নাকি লাইভ দেখাচ্ছে। গিয়ে শুনি এক ফেরিওয়ালা এবং ছিনতাইকারীর মধ্যে মারামারি। আর সেটাকে কেন্দ্র করে দুজনের পক্ষেই ২০/২৫ জন লোক জড়ো হয়েছে। কানামাছি খেলাকে কেন্দ্র করে বাচ্চারা যেরকম ছুটোছুটি করে ঠিক তেমনি থেমে থেমে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চলে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া খেলা। আর একটি টিভি চ্যানেল কিছুক্ষণ পর পরই পার্ক থেকে এমনভাবে লাইভ দেখাচ্ছে যেকারও মনে হবে দেশের ভেতরে কোন গৃহযুদ্ধ লেগে গেছে। কোন যুক্তিতে এই লাইভ ? কেন তুচ্ছ এই ঘটনাটিকে গুরুত্ব দেয়া ? ঘটনাস্থলে আসা সকল গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে এসবই ছিলো আলোচ্য বিষয়। এ নিয়ে এক সহকর্মীর মন্তব্য, ‘চ্যানেলটি সম্ভবত লাইভের নতুন যন্ত্রপাতি এনেছে তা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করতেই বার বার এই লাইভ দেখানো’। আরেক সিনিয়র সাংবাদিক বলেন..‘আরে.. না ভাই ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেল। সময়টা পূরণ করতে হবে । দেশে কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর নাই। সুতরাং দর্শক টানার জন্য কিছু একটাতো করে দেখাতে হবে… বুঝাতে হবে আমরা এক্সক্লুসিভ সব মারামারি লাইভ দেখাই আমাদের সাথে থাকুন’। দ্বিতীয় জনের বক্তব্য যদি ঠিক হয়, তবে অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই বলার নাই। যে নিউজ এডিটর ঐ চ্যানেলের লাইভ দেখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন, তাকে বিষয়টি খুলে বলার পর তিনি বেশ মজা পেলেন, আর অট্টহাসি দিযে বললেন -বাদ দাও এসব ফালতু নিউজ।

humayun
হুমায়ূণ আহমেদের কবর খোঁড়ার দৃশ্য লাইভ দেখানো হয় !!

২০১২ সালের ১৯ জুলাই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ মারা গেলেন আমেরিকায়। বিমানবন্দরে তার লাশ আসা থেকে শুরু করে সব কিছু লাইভ দেখাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় সব নিউজ চ্যানেল। লাশ কোথায় দাফন হবে এ নিয়ে দুই পরিবারের দ্বন্দ্বের একান্ত ব্যাক্তিগত-পারিবারিক বিষয়টিও লাইভে প্রচার করা হয়। স্বামীহারা শাওন, ভাইহারা জাফর ইকবাল আর সন্তানহারা হুমায়ুনের মায়ের মানসিক অবস্থা বিবেচনা না করে বারবার তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে লাইভে এক্সক্লুসিভ কিছু বের করার চেষ্টা করেন একটি চ্যানেলের একজন স্বনামধন্য নারী রিপোর্টার।

হঠাৎ খবর আসে হুমায়ুন আহমেদকে নুহাশ পল্লীতে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এমন খবরে গাজীপুরে হুমড়ি খেয়ে পড়েন লাইভ মাষ্টাররা। হুমায়ূন আহমেদকে তখনও কবর দেয়া হয়নি। লাইভের এক পর্যায়ে দেখলাম একটি চ্যানেলের রিপোর্টার কবর খোঁড়ার দৃশ্য দেখাচ্ছেন আর লিচু গাছের নিচে কেন কবর দেয়া হচ্ছে তার বর্ণনা দিচ্ছেন।এতটুকু পর্যন্ত মানা যায়। কিন্তু এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি নেমে পড়লেন কবরে। নেমে গিয়ে কবরের ভেতর মাটি ধরে দেখাচ্ছেন মাটি শুকনো না স্যাঁতস্যাঁতে … এবার কিন্তু দর্শকদের কাছে বিষয়টি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে।

কবর যারা খুঁড়ছেন তারা তাকে ওঠে যেতে ইশারা দিলেও তিনি ওঠছেন না। চালিয়ে যাচ্ছেন তার লাইভ। সাংবাদিকতার কোন নীতির মধ্যে পড়ে এ বিষয়টি ? একই ঘটনা দেখেছি রানা প্লাজায় নিহতদের কবর দেবার সময় আরেকজন রিপোর্টার একইভাবে কবরে নেমে পড়েছিলেন। ভাগ্য ভালো যে ঐ অতি উৎসাহী রিপোর্টাররা মৃতদেহের সাথে কবরে গিযে লাইভ করার দু:সাহস দেখাননি। সেটা করলে হয়তো তাদের নিজেদেরই লাইভ কানেকশন চিরতরে ছুটে যেত।

TV Jn 1
রানা প্লাজায় নিহতদের কবরে জুতাসহ নেমে পড়ে লাইভ দিচ্ছেন এক রিপোর্টার !!!

লাইভ দেয়ার সময় কোন- কোন রিপোর্টারের মধ্যে সম্ভবত হিরোইজম এসে ভর করে। আর সে কারণেই রানা প্লাজা ধসের পর যখন উদ্ধার কাজ চলছে, তখন দেখি উদ্ধার কর্মীদের সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ ফুট গভীর সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েন একটি চ্যানেলের সাংবাদিক। যেকোন সময় ঐ সুড়ঙ্গ ভেঙে পড়তে পারে জেনেও ভেতর থেকে টানা বিশ মিনিট ধরে চলে তার লাইভ। পিলারের নীচে চাপা পড়া আহত গার্মেন্টস কর্মীদের সাথে চলে তার লাইভ কথপোকথন। তিনি জানতে চান গরমে অন্ধকারে আটকে পড়ে তাদের কেমন লাগছে ? একজন মৃত্যু পথযাত্রীকে এসব প্রশ্ন করা নিছক হাস্যকর ছাড়া আর কি হতে পারে ? কিন্তু ঐ চ্যানেলে যেভাবে এক্সক্লুসিভ হিসেবে এটাকে চালানো হচ্ছে তাতে স্পষ্ট চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি দেখাতে পেরে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলছেন। এখন প্রশ্ন হলো এই ধরনের লাইভ সাংবাদিকতা কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে কিনা ? এটা আদৌ গহণযোগ্য কিনা ?

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং কর্মরত একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে- এটা একবারেই অনৈতিক এবং বাড়াবাড়ি। বিশেষ করে একজন রিপোর্টারকে ঝুঁকির মুখে ধ্বংসস্তুপের ভেতর ঠেলে দিয়ে, টেলিভিশনের পর্দায় এক্সক্লুসিভ সিল সেঁটে দিয়ে সে ভিডিও ফুটেজ দেখানো এবং একই সাথে মৃত্যু পথযাত্রীদের কেমন লাগছে এই ধরনের প্রশ্ন করাটা।

TVJn 4
রানাপ্লাজা ধসে চাপা পড়া এসব অসহায় মানুষকে লাইভে জিজ্ঞেস করা হয় কি অনুভূতি আপনার !!!!

২০১৪ সালে ৩০ শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের ঘটনার পর নদী থেকে লাশ উদ্ধার হলো। বেশ কয়েকটি চ্যানেল লাইভ করলো। একটি নতুন চ্যানেলের একজন নতুন রিপোর্টার লাইভে মৃতদেহের শরীর ফুলে যাবার বিষয়টি লাশের পেটে হাত দিয়ে দেখাচ্ছিলেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি মৃতদেহের হাতের আঙ্গুলে আংটি আছে এবং তার হাত পেছন থেকে বাধা অবস্থায় পানিতে ভেসে আছে। আর অতি উৎসাহী ঐ রিপোর্টার লাশের হাতের দড়িটি এবং আংটিটি টেনে টেনে দেখাচ্ছেন। ভাবা যায় ? তিনি একজন রিপোর্টার !!!! স্পর্শ না করে তো ঘটনার  বিবরণ দেয়া যায়। খুব জানতে ইচ্ছে করে কারা এদের সাংবাদিক বানিয়েছে ? আর তাদেরইবা এই অতি-উৎসাহ কেন ?

এই ঘটনার চারদিন পর একটি চ্যানেলের একজন সিনিয়র রিপোর্টার সেভেন মার্ডার নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন করলেন। প্রতিবেদনের শেষ পর্যায়ে পিটিসিতে দেখা গেল তিনি ধীরে ধীরে শীতলক্ষা নদীর গভীর পানিতে চলে যাচ্ছেন। বুক সমান পানিতে গিয়ে বললেন ‘ এই বুক সমান পানিতে সাতটি লাশের সাথে পাথর বেঁধে তাদের পানিতে ডুবিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা’। এই বিষয়টি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি অনায়াসেই বলতে পারতেন। তাকে জুতা কাপড় নিয়ে বুক সমান পানিতে কেন যেতে হলো ভেবে পাইনা !! তবে পিটিসিতে তার এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছিলো -এই বুঝি রিপোর্টার ডুব দিয়ে পানির নিচ থেকে বলবেন ‘শীতলক্ষার এই নোংরা পানির নিচেই তাদের লাশ সাত দিন পড়ে ছিলো, এখনও সেখান থেকে দুর্গন্ধ পাচ্ছি।’ শেষ পর্যন্ত ডুব দিয়ে টেলিভিশন সাংবাদিকতাকে তিনি আর অপমান করেননি। সেজন্য তাকে ধন্যবাদ।

Narayan 1
শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠছে নিহতদের লাশ

হ্যাঁ এটা ঠিক প্রতিবেদক তার রিপোর্টের সাথে অথবা লাইভের সাথে দর্শকদের একাত্ম করবেন এটা স্বাভাবিক, কিন্তু তার মানে এই না যে সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাবে।

অনেক সময় লাইভে কোন বিষয়টি বলা উচিত, আর কোন বিষয়টি বলা উচিত নয়- তা বুঝে ওঠতে পারেন না কোন-কোন রিপোর্টার। একটি উদাহরণ দিলে এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। যেমন- ৫ই জানুয়ারী নির্বাচনের পর ফলাফল বিষয়ে বিএনপির একটি আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিং। তখনও ব্রিফিং শুরু হয়নি। একটি চ্যানেল লাইভে ঢুকল। রিপোর্টার জানাচ্ছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠক করছেন কিছুক্ষণ পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দলের বক্তব্য জানানো হবে। ঐ মুহূর্তে রিপোর্টারের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল। রিপোর্টার কথা বলতে চাইলেও তিনি কথা না বলে তাকে সরিয়ে দিয়ে পাশের রুমের দিকে গেলেন। ঐ চ্যানেলের নারী উপস্থাপক বেশ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইলেন ‘মিটিং কি শেষ? ফখরুল কেন কথা বললেন না, তিনি কি চলে গেলেন?’ সাথে সাথে রিপোর্টারের জবাব- না তিনি এইমাত্র ওয়াশরুমে গেলেন। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে মিটিং শেষে তিনিই আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করবেন। ভাগ্য ভালো যে ঐ রিপোর্টার ওয়াশরুমের দরজা নক করে তার লাইভ বক্তব্য প্রচার করার দু:সাহস দেখাননি।

istema
বিশ্ব ইজতেমায় আখেরী মোনাজাত

বিশ্ব ইজতেমা। তাবলীগ জামায়াতের মহা মিলনমেলা। হজের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই জমায়েত। তাই গুরুত্ব দিয়েই চ্যানেলগুলো লাইভ করে। ইজতেমা মাঠের চারপাশে বাঁশ দিয়ে চারতলা উচ্চতার সমান উঁচু ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকে র‌্যাব-পুলিশ নিয়মিত দূরবীন দিয়ে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। ঐ টাওয়ারের নিচেই আমরা কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মুসল্লীর ভক্সপপ নিচ্ছি। সেসময় দেখলাম ঐ টাওয়ারে ওঠে লাইভ দিতে নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে বেশ তর্ক করছে একটি চ্যানেলের রিপোর্টার। তারা যতই বোঝায় এটা শুধু একজন নিরাত্তা রক্ষীর জন্য, বেশি ভার নিতে পারবেনা। এটা নড়বড়ে, ভেঙ্গে যেতে পারে। কিন্তু ঐ চ্যানেলের রিপোর্টার আর ক্যামেরাম্যান নাছোড় বান্দা। তাদের যুক্তি ‘ টাওয়ারে ওঠে লাইভ দিলে ব্যাকগ্রাউন্ড খুব ভালো আসে। ইজতেমার মাঠ পুরোটাই দেখানো যায়’। শেষ পর্যন্ত অনুমতি মেলে। মহানন্দে তারা ওঠে যায় টাওয়ারের চূড়ায়। কোন স্থানে দাঁড়িয়ে লাইভ দিলে ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো আসবে, এজন্য রিপোর্টার ক্যামেরাম্যানের পরামর্শমতো মতো এদিক ওদিক যাচ্ছিল। অতিরিক্ত ওজনের কারণে ততক্ষণে বাঁশের ওয়াচ টাওয়ার দুলছে। হঠাৎ রিপোর্টারের পায়ের নিচের বাঁশটি সরে গিয়ে পা পিছলে যায়। তিনি পড়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশের কনস্টেবল তার আরেক পা ধরে ফেললে তিনি বাঁদুরের মতো ঝুলতে থাকেন। হুজুরদের ভক্সপপ নেয়া বন্ধ করে আমরাও দর্শক হয়ে যাই।  দেখি নিচ থেকে তাবলীগের হুজুরররা ঐ দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করছেন। ততক্ষণে চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান ওয়াচ টাওয়ারের এক সিঁড়ি নিচে এসে তাকে কোন মতে টেনে তোলেন। নিচে তাবলীগের হুজুররা হাততালি দিলেন। শেষ পর্যন্ত লাইভ না দিয়ে নিজেই লাইভের বিষয়বস্তু হয়ে টাওয়ার থেকে নেমে আসেন রিপোর্টার। মূলত  নিরাপত্তাকর্মীদের নিষেধ স্বত্বেও  হিরোইজম দেখাতে গিয়ে জীবনটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল ঐ রিপোর্টারের।

TVJN2
ভারতে টিভি সাংবাদিকের বিতর্কিত পিটিসির দৃশ্য

পরে সন্ধ্যায় বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরিয়ে বিশ্ব ইজতেমার সংবাদ দেখছি। দেখি একটি প্রতিষ্ঠিত চ্যানেল তাবলীগ জামায়াতের আখেরী মোনাজাত শেষে ঘরে ফেরা নিয়ে একটি সাইড স্টোরি দেখাচ্ছে। রিপোর্টের বিষয় যানবাহন সংকটে ঘরে ফেরার দূর্ভোগ। রিপোর্টের শেষ দৃশ্যে অসংখ্য মানুষের সাথে রিপোর্টার ট্রেনের ছাদে। সবাই বসে আর রিপোর্টার চলন্ত ট্রেনের ছাদে দাঁড়িয়ে পিটিসি দিচ্ছেন। পিটিসির শেষ পর্যায়ে একটি গাছের ডালের সাথে ধাক্কা খেয়ে তিনি চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন। আর অসমাপ্ত পিটিসি রেখেই পে- অফ দিয়ে শেষ হলো রিপোর্ট । দৃশ্যটা দেখে যেকোন দর্শকের বুকটা ধুক করে উঠবে। জানতে ইচ্ছে করবে রিপোর্টার ট্রেন থেকে পড়ে গেলো কিনা? বেঁচে আছেন কিনা? পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি একটি চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিনিধি। তার মাথায় গুরুতর জখম হয়েছে, তবে তার ভাগ্য ভালো তাবলীগের হুজুররা ধরে ফেলাতে ট্রেন থেকে তিনি ছিটকে পড়েননি। এখন প্রশ্ন হলো কেন এই ধরনের ঝুকিপূর্ণ পিটিসি দেয়া ? আর টেলিভিশনে আনকাটভাবে কেন তা প্রচার করা ? রিপোর্টার যেমন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন এ পিটিসি দিয়ে, ঠিক একইভাবে দর্শককে চমকে দেয়ার লোভ সংবরণ করতে না পেরে ঐ অংশটুকু প্রচার করে ঐ চ্যানেলটি কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে?

আমাদের দেশেই যে এসব অদ্ভুদ ঘটনা ঘটে তা নয়, পার্শ্ববর্তী দেশেও এরকম হিরোইজমের চিত্র দেখা যায়। প্রায় বছরখানেক আগে পার্শ্ববর্তী দেশে বন্যাদুর্গতদের নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে সেখানকার এক টেলিভিশন সাংবাদিক বন্যাদুর্গত এক ব্যক্তির কাঁধে ওঠে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে পিটিসি দিলেন। যার কাঁধে চড়ে পিটিসি দিচ্ছেন তিনি কোমর সমান পানিতে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছেন। ঐ পিটিসি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে সমগ্র ভারতজুড়ে। তোপের মুখে ঐ রিপোর্টারকে চাকুরিচ্যুত করতে বাধ্য হয় চ্যানেলটি।

এই ধরনের চর্চা বন্ধ না হলে টেলিভিশন সাংবাদিকতা  তার মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে কি ?  বরং এটা অব্যাহত থাকলে মানুষের দু:খ- দুর্দশা তুলে ধরার পরিবর্তে নিজেরাই জন্ম দেবে নতুন-নতুন দুর্ভোগ আর বিতর্কের।  আর সেকারণেই পেশাদারিত্বের বিষযটি মাথায় রেখেই প্রশিক্ষিত  জনবল নিয়োগে  যেমন সোচ্চার হওয়া উচিত গণমাধ্যমগুলোকে তেমনি একইসাথে  সাংবাদিকতার নীতি মেনে লাইভ  এবং পিটিসির বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ঐক্যমতে  পৌঁছানোে এখন সময়ের দাবি।

(চলবে)


এরকম আরো কিছু সংবাদঃ

টেলিভিশন সাংবাদিকতার কৌশল (পর্ব-৩): রাকিব হাসান

রাকিব হাসান

লেখক: চ.বি যোগোযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও টেলিভিশন সাংবাদিক।

 

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G