আহমদ ছফার প্রাসঙ্গিকতা: ছফা ভক্তির নেপথ্য কথা

প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২৪, ২০১৫ সময়ঃ ৫:৫০ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:৫৭ অপরাহ্ণ

 11755815_407565469434154_7946799883753570785_nকলেজের প্রথম বর্ষেই ছফা নামটি পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন এক মাস্টার। সাধারণেৎ ছফারচে ছফি, শফা, সফা ইত্যাকার শব্দ লাগসই; মাস্টারের দোষ দিইবা কিভাবে? চট্টলরত্ন যদি অজস্র হয় তবে ছফা বৌদ্ধিক প্রাখর্য্যে সর্বাগ্রগন্য। আর একজন ভাবতে চাইলে ছফা অনন্য (অন্তত সাহসের সত্যে, সত্যেও সাহসে) বলতেই হয়, আমরা শরীফকে বিস্মৃত হইনি। নোবেল লরিয়েটও অজ্ঞাতে নয় নিবন্ধকারের। তবুও ছফাকে শীর্ষাসনে ভাবার মধ্যে আবেগের চেয়ে আসলের মূল্যায়নে হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।

কড়ির লোভ,পদপ্রবৃত্তি আর প্রভুসন্নিধানের দুর্মর আকাঙক্ষা আমাদের জাতীয় চেতনার জন্যে প্রধানতম বাধা। যাদের অষ্টপ্রহর পর্দায় দেখি, বেপর্দায় দেখি এঁরা সকলে লাভে-লোভে পরাস্তই নয় তেজহীনও। নইলে ছফাসক্ত শিক্ষা উপদেষ্টা এমন নির্মোহও নৈর্ব্যক্তিক থাকেন কী করে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে? টাকায় শার্দুল দুধ মেলে কি-না জানিনে। জানি, শার্দুল তুল্য মস্তিস্ক টাকায় নয়, পয়সার বিক্রীত হয় এ বাংলায়। ভ্যাগিস ছফা শারীরিক বেঁচে নেই। নইলে বর্তমান সময়টা অনেক পতাকা শোভিতদের জন্যে দুর্বহ হয়ে উঠতো। ছফারশির ছিল দুর্বিনীত সত্যেও অদ্ভূত শহিদমিনার। বিবেচনা ছিল প্রাগ্রসর দার্শনিকের অব্যর্থ অনুধ্যানের অবিনাশী উজ্জ্বলতায় বিভাময়। বাক্য উচ্চারণে ছিলেন খাপখোলা। আর চিন্তার শুদ্ধতায় তার তুলনায় খূঁজে… চলেছি খুঁজব বটে মিলবেনা। আজকে যারা সর্বত্র বৃত সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে তাদের দাঁড়ানোর স্থানটা ছিল এক সময় শঙ্কার মুখে। সৈনিক ছফা তাদের উদ্ধার করলেন উদ্বাস্তুর নির্মমতা থেকে।

‘ছফা ভাই বললেন, গণভবনে যাব। নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে অগুন লাগিয়ে দেব। একটি শহীদ পরিবারের প্রতি যে অপমান করা হয়েছে- তার প্রতিবাদে এই কাজটা করব। আত্মাহুতি।’
পড়বেনা তাঁর পায়ের চিহ্ন- হুমায়ুন আহমেদ
শুধু স্মৃতিচারণ করে ক্ষান্ত দিলেই হয় না। এমন মহৎ প্রাণ সুহৃৎকে নিযে আরো গভীরে যাওয়া উচিৎ ঐ ভ্রাতৃদ্বয়ের। না চন্দনাশাইশে মাজার নয় ছফা ছফাভাবনার প্রসারে আরো দুদন্ড সময় চায় বোদ্ধারা।
আশ্চর্য স্বদেশ আমার। পদার্জনে জান বিসর্জনের চেষ্টা চলে এখানে। অথচ অসম্মানে পদবর্জনের রুচি তৈরী হয়নি একজনেরও। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আমাদের ছফা.. বঙ্গবন্ধুর ফোন-
হ্যালো: আমি মুজিব বলছি
জ্বী: আহমেদ ছফা (স্লামালেকুম)
মুজিব: আপনাকে জার্মানির রাষ্ট্রদূত করতে চাই
ছফা: রাজি আছি
মুজিব: কিছু শর্ত আছে।
ছফা: কী বললেন শর্ত? শর্ত মেনে কোন কাজ করিনি –করব না–রিসিভার ছফাই রাখলেন।
বঙ্গবন্ধুর অচল পরিমাণ ব্যক্তিত্বেও সামনে অব্যয় অক্ষয় ছফার অবিস্মরণীয় সাহসিকতার কথা কবুল করতে ভীরু হৃদয় কেঁপে উঠে। চিত্তের মধ্যে কত অঢেল শক্তি সঞ্চিত থ্কলে অমন প্রত্যাখান সম্ভব আমাদের অজানা।ততততততততত

একটা গাড়ি পাঠালেই উপদেশক হবার লোভ দূত হবার ভূতরোগ ছাড়তে পারিনে আমরা। এবং লক্ষনীয় যারা দেশ চালাচ্ছেন তারা সকলে সমসাময়িক এবং প্রায় সমান যোগ্যতার। বর্তমান সময়ে একজন ছফার প্রয়োজনীয়তা কত তীব্র তা তাঁরা বক্তব্য দিয়েই প্রমাণ নেয়া যাক…
মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা এবং হানাহানি দেখে আকাশে পাকির জগতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম্ সেখানেও হিংস্রতা এবং জাতি বৈরীতার প্রকোপ দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং মানুষের মতো কর্তব্য পালনে করার জন্য আমার মানুষের কাছে ফিরে না গিয়ে উপায় কি? আমি বৃক্ষ নই, পাখি নই, মানুষ। ভাল হোক , মন্দ হোক, আনন্দের হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মতো মানুষের সমাজে মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে। মনুষ্যলীলার করুণ রঙ্গভূমিতে আমাকে নেমে আসতে হবে।’
পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরান (পৃ: ৭৯)

ছফা নির্মেদ অপ্রয়োজনের সাহিত্যক নন। পোড়া খাওয়া অনগ্রসর বাঙালির মধ্যবিত্তের ঘরে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সামনন্ত ভাবনার আয়েশী ভঙ্গিকে তিনি শুধু প্রত্যাখানই নয় বিচূর্ন করতে সচেষ্ট ছিলেন। দিনানুদিন যাদের চলে অব্যক্ত কষ্টে, তাদের জন্যে দরদ ছিলো ছফার অন্য যে কারো চাইতে বেশি। সেজন্যে সৌখিন কলম – কলামধারী হিসেবে তাকে দেখলে ভুল হবে। সাহিত্যেও কামলা ছিলেন ছফা। ছফাকে সবচে বেশে ধরতে পেরেছেন একালের আরেক মৌলিক চিন্তক ফরহাদ মজহার। বন্ধুত্বেও খাতিরে তেলানোর জন্যে নয়, আসন্ন তারুণ্যের সঠিক উপলব্ধির জন্যে মজহারকে লিখতে হয়েছে..
‘প্রথমেই বলি, আহমদ ছফা তিরিশ দশকীয় সাহিত্যেও প্রডাক্ট নন। অর্থ্যাৎ ঔপনিবেশিক কলকাতায় সাহিত্যসর্বস্ব কেরানিমার্কানন। এই কালের বাংলা ভাষার বাইরের জাঁকজমক সেঅভিভ’ত হয়নি। সুধীন দত্ত বা বুদ্ধদেব বসুকে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সে অচিরে টের পেয়েছিল এগুরো ঠুনকো জিনিস। ওসব দিয়ে আনন্দবাজার সানন্দা মার্কা ব্যবসা চালানো যায় কিন্তু ভেতরে খাঁটি মাল কিছু নেই বললেই চলে। অন্তঃসারশূন্য।’
-আহমেদ ছফা এবং মানুষের মতো কর্তব্য কিংবা ব্যক্তির মুক্তিতন্ত্র- ফরহাদ মজহার।

৫ ডিসেম্বর ’ ৭২ সাল- আহমেদ ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে ২০৬ নং কক্ষে বসে লিখেছেন, “আমরা এমন একযুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারিদিেিক এত অন্যায় , আবিচার এত মূঢ়তা এবং কাপুরূষতা ওঁৎ পেতে আছে যে এ ধরনের পরিবেশ নিতান্ত সহজ কথাও চোঁচয়ে না বললে কেউ কানে তোলে না।” তাঁর বিখ্যাত ও ব্যতিক্রম গ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে’র ভূমিকার প্রথমাংশ তুলে ধরলাম। আশ্চর্য এই যে..
বাহাত্তুরের দৈন্যদশা আজও বাংলাদেশে বিরাজমান এবং আপতিক কিছু উন্নয়ন বাদে বাকি অংশের অবনমনই হয়েছে বলতে হবে। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটির প্রতি জাতির কৌতুহল অপার। আর আমার দেশের ‘সুশীল সমাজকে নিয়ে নানা রংচটা কথা বাজাওে চালু আছে। কেউ খালেদার পদপাশে নিমজ্জমান আর কেউ হাসিনার আঁচলে চঞ্চু ঘঁষে শান দেন অষ্টপ্রহর। পার্টিজান সেসেব সুশীলদের দৌরাত্য অসহ্য ঠেকেছির আহমেদ ছফার কাছে। বিবিকবিসর্র্জী ওসব বিদ্যার জাহাজের মুখোশ উপড়াতে ছফার ক্ষুরধার বক্তব্য জানা যাক, “ আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে – প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালী হয়েছেন সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটরদেও মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা অন্ধভাবে হলেও ইসিলাম পাকিস্তান ইত্যাদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যাঁরা সারা জীবন কোন কিছুতে যদি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন- সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।
২০০৮ এর প্রেক্ষাপটে ছফার উক্তি, মূল্যায়ন কতটা অব্যর্থ আর দার্শনিকতাসুলভ ভেবে- দেখবার প্রয়োজন কিন্তু। আজকের বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের সাদা-নীলের কারিশমা জাতিকে হতাশ করে। বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে ক্ষুন্নিবৃত্তির সম্পর্ক এমন নিবিড় আর কোন রাষ্ট্রে দৃশ্যমান কিনা আমাদের জনা নেই। একটা দেশের মৌল কাঠামোটি গড়ে উঠবে যাদের বৌদ্ধিক দৃঢ়তার উপর তারাই যখন হালুয়ামও হন তখন সে দেশের কি দশা হতে পাওে বলাই বাহুল্য। এরূপ পচনে পতনে আমারা ক্রমাগত বিরুদ্দতার সঙ্গে পেরে উঠছিনা মোটেই। অতএব কর্তব্য নির্ধারণ জরুরি। আর এক্ষেত্রে ছফার প্রতি দৃষ্টি দেবার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দেশ ও দশের ক্রান্তিকালে ছফাদের পাঠ অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। আমাদের শত ছফার দরকার। ভঙ্গুর, অপসৃয়মান, পতনোন্মুখ এবং দ্বন্দ্বকীর্ণ একটি জাতির সামূহিক দুর্দশার সামনে ছফা এক আশাবাদের বহ্নিশিখা।

ঋালবাসার ন্যে কার্যারণ লাগেনা। ভাললাগার জন্যে লাগে। ছফা আমার ভাললাগা-ভালবাসা নয়। আবেগী গীতিকার ফুলকে ক্ষণিকের ভাললাগা বলে ভুল করেছেনবলে আমরা বিভ্রান্ত হই। ওইটে অন্য ডিসকোর্স হয়তো। শরীরী ছফার অন্তর্ধানে ক্ষতি হয়েছে আমাদেও কিন্তু ছাপানো ছফা আছেন। ভণিতা না করে পাঠককুলকে আকুল আকুতি জানাই ছফাকে পাঠ করুন- অনাস্বাদিত ব্যঞ্জনের স্পর্শে পুলকিত হবেন। আর চেতনার হিমাগাওে তপ্ত চাবুকের আঘাত হানতে ছাপানো ছফার অনন্য আরকের কার্যকারিতা রাখে।
চিন্তার দৈন্য, বিদ্যার বৈকল্য, বুদ্ধির আড়ষ্টতা কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের । স্বচ্ছতার দুর্বিপাক, সুন্দরের করুণ গোঙ্গানি আর মানবতার অনিঃশেষ হাহাকার চারপাশ ভারী আজ। হ্যাঁ সবকিছু নষ্টরাই আগলে ধরেছে সে অনেক আগে থেকে। একজন, একদল, ছফাভক্তের জন্যে জাতি অপেক্ষা করে আছে। জেগে উঠুক বোধ, বুদ্ধি তাই-ই বলছে।

মিজানুর রহমান

প্রভাষক, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ।

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G