কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ব্যয় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশঃ নভেম্বর ২৪, ২০১৫ সময়ঃ ৭:৪৩ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:১৮ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

karnafuli tannelবন্দরনগরী চট্টগ্রামে বহুল প্রত্যাশিত কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে যুক্ত করতে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার।

মঙ্গলবার শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের বৈঠকের পর পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ২০২০ সালের আগে টানেলটি নির্মাণ শেষ হলে চট্টগ্রাম একটি অন্যতম আধুনিক শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

কর্ণফুলী টানেল বাস্তবায়নে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন (জিওবি) ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি ২০ লাখ এবং প্রকল্প সাহায্য ৪ হাজার ৭৯৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রকল্প সাহায্য প্রদানকারী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক।

দেশের প্রথম এ টানেল বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে একেবারেই বদলে দেবে। চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’-এর মর্যাদা পাবে চট্টগ্রাম। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটি এ অঞ্চলের কোটি মানুষের ভাগ্য বদলে দেবে।

দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রাম মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা কর্ণফুলী চট্টগ্রামকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। মূল মহানগর এবং বন্দর এলাকা কর্ণফুলী নদীর পশ্চিমপাশে অবস্থিত। অন্যদিকে, ভারি শিল্প এলাকা পূর্বপাশে অবস্থিত। কর্ণফুলীর পশ্চিমপাশে সমৃদ্ধ মহানগরী গড়ে উঠলেও পূর্বপাশে এখনও গ্রাম। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি সেখানে। অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে কর্ণফুলীর পূর্বপারে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ভারি শিল্পকারখানা। আনোয়ারার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গড়ে উঠছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড)।

টানেলের মধ্য দিয়ে দু’পারে সেতুবন্ধন রচিত হলে নদীর পূর্বপাশে আনোয়ারা-পটিয়া থেকে শুরু করে বিস্তীর্ণ এলাকা উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় মিলিত হবে। শিল্পায়নের পাশাপাশি সেই অঞ্চলের লাখো মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে- এমন প্রত্যাশা থেকে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

৯০-এর দশকে জাপানভিত্তিক উন্নয়ন-গবেষণা প্রতিষ্ঠান জাইকা সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাতে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলী নদীতে ব্রিজ নির্মাণের বদলে তলদেশে টানেল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। কর্ণফুলীর পূর্বপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ৯০ সালের দিকেই টানেল নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাইকা। কিন্তু নানা জটিলতা আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে ওই টানেল বাস্তবায়িত হয়নি।

শত বছরের পুরনো কালুরঘাট রেলসেতুর পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীতে আরও দুটি সেতু নির্মাণ করা হয়। এসব সেতু নির্মাণের ফলে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে, যা বন্দরের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে কর্ণফুলী নদী রক্ষা এবং সেই সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগরীর যোগাযোগ সহজতর করতে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় সেতু বিভাগ।

গত ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে শেষ নির্বাচনী জনসভায় চট্টগ্রামের উন্নয়নে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই নির্বাচনী অঙ্গীকারের অন্যতম ছিল কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ। সরকারের প্রথম মেয়াদে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তাতে গতি আসেনি।

দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেন। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রকল্পের প্রতিটি ধাপ এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।

প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আগ্রহে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইসহ আনুষঙ্গিক বিষয় ঠিক করতে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে চীনের ‘চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড’ কে (সিসিসিসি) প্রকল্পটির পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের ১৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০১১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সমীক্ষা করে সিসিসিসি রিপোর্ট পেশ করে। ওই রিপোর্টে টানেলের ব্যাপারে বিস্তারিত সুপারিশ করা হয়।

এতে বলা হয়, নদীর তলদেশে টানেল হবে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এ ছাড়া পূর্বপ্রান্তের ৪ দশমিক ৯৫২ কিলোমিটার এবং পশ্চিমপ্রান্তের ৭৪০ মিটার সংযোগ সড়কসহ টানেলের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৯ দশমিক ০৯২ কিলোমিটার। এ ছাড়া টোল বুথ এবং টোল প্লাজা নির্মাণ করতে হবে ৭২০০ বর্গমিটার। চার লেনের টানেলে উভয় পাশে দুই লেন করে থাকবে।এতে দুটি টিউব নির্মিত হবে। প্রতিটি টিউবের ব্যাস হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার। টানেলটি কর্ণফুলী নদীর কমপক্ষে ৪২.৮ মিটার গভীর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মহানগরীর সিমেন্ট ক্রসিং এলাকা থেকে টানেলটি শুরু হয়ে নদীর ওপারে আনোয়ারায় শেষ হবে।

সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, টানেল নির্মাণ করা হলে কর্ণফুলী নদীর দুইপাশে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে মহেশখালীতে গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ ছাড়া মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, এতে করে টানেলের গুরুত্ব বাড়বে। মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় একটি মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

প্রতিক্ষণ/এডি/জেডএমলি

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G