কাগজের ঠোঙার বদলে গ্লাসে ‘বাঙালি ঝালমুড়ি’!

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫ সময়ঃ ২:৩০ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:০২ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:

jal-mori.thumbnailপ্লিজ, কাম হিয়ার। প্লিজ, টেস্ট মাই স্পেশাল স্পাইসি ঝালমুড়ি। প্লিজ।’ ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে দাঁড়িয়ে ইংরেজিই তো শুনব। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ‘ঝালমুড়ি’!!

স্বভাবতই যে কান দিয়ে ‘ঝালমুড়ি’ শব্দটা প্রবেশ করল, ঘাড়টাও সেদিকে ঘুরে গেল। ওমা, এ যে দেখি পুরো দেশি কায়দায় বিলেতি ঝালমুড়ি। যিনি ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন, তিনি একজন বাঙালি।

পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলে সবজি বাজারের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করছিলেন বাংলাদেশের বরিশালের আবদুর রহিম। বয়স ৫৩ বা ৫৪ বছর হবে।

কাছে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে বসলাম, ‘বাড়ি কই চাচা?’ বিদেশ-বিভুইয়ে দেশি ভাষা শুনে তিনিও আবেগে আপ্লুত। শুরু হলো কথা। জোর করে তিন গ্লাস স্পেশাল মুড়িও বানিয়ে খাওয়ালেন।

দেশের ঝালমুড়ির কাগজের ঠোঙার বদলে গ্লাস, স্বাদটাও খানিকটা অন্যরকম। ঝালমুড়ি খেতে খেতে শুনলাম, আবদুর রহিমের জীবনযুদ্ধের কথা। কথা বলার ফাঁকেই তিনি বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছিলেন ঝালমুড়ি।

স্মৃতি হাতড়ে আবদুর রহিম চলে গেলেন ১৬ বছর পেছনে। তখন তিনি তরতাজা যুবক। প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে প্রথমে দুবাইয়ে পা রাখেন। মাস দুয়েক নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজও করেন। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে মাটির নিচের একটি ঘরে ২০-২২ জনের একসঙ্গে থাকাটা যেন তাঁর কাছে নরক বলে মনে হতো। এরপর আরেক দালালের হাত ধরে সমুদ্রপথে ব্রাজিল। এভাবেই মোট চারটি দেশ ঘুরে অবশেষে লন্ডনে পৌঁছলেন তিনি। তত দিনে পার হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর।

স্বল্প শিক্ষা, ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণেই কোথাও নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি আবদুর রহিম। হঠাৎ করে তাঁর মনে হলো ঝালমুড়ি বানিয়ে বেচলে কেমন হয়? কারণ সারা দিন কাজ শেষে বাসায় ফেরার পরে তিনি মরিচ-পেঁয়াজ মাখিয়ে যে মুড়ি বানান, সেটা কিন্তু তাঁর অন্য সঙ্গীরা বেশ মজা করেই খান। এই সঙ্গীদের কেউ ফিলিপাইনের, কেউ মরক্কোর, কেউবা আফ্রিকার কোনো দেশের বাসিন্দা। যেই ভাবা, সেই কাজ। নেমে পড়লেন কাজে।

সব মিলিয়ে ৩৫ পাউন্ড জোগাড় করে শুরু হয়ে গেল লন্ডনের ঠেলাগাড়িতে আবদুর রহিমের ভাসমান ঝালমুড়ির ব্যবসা। ভালোই আছেন এখন। ছয় মাস পরপর বাংলাদেশে টাকা পাঠান। বছর দশেক দেশে ফিরে বিয়ে করেন। একটি ছেলেও আছে। তবে পুরো পরিবার থাকে বরিশাল শহরে।

আবদুর রহিম বাংলা ভাষায় কথা বলতে ছটফট করেন। তাঁর মতে, এখানে প্রায় সবাই সিলেটি বাংলায় কথা বলেন। দেশের রাজনীতির খবরও ভালোই রাখেন তিনি। কোন সরকার কেমন করছে, তাও বলে যাচ্ছিলেন। জানালেন, মাঝেমধ্যে টাওয়ার হ্যামলেটের বিভিন্ন সভাতে যান তিনি। সেখানে দেশের খবর পান, ঝালমুড়ির বেচাবিক্রিও ভালো হয়। আবদুর রহিম খানিকটা গর্ব করেই জানালেন, টাওয়ার হ্যামলেটের সদ্য নির্বাচিত মেয়র লুৎফর রহমানও তাঁর ঝালমুড়ির ভক্ত।

ইংরেজিও তো ভালো জানেন না, তাহলে ব্যবসা চলে কেমন করে? আবদুর রহিমের জবাব, ‘হইয়া যায়। কিছুটা ‘ককি’ও জানি।’ এটি আবার কী? ‘এইখানের ভাষা। রাস্তার ভাষা।’

পরে জানলাম, এখানকার স্ট্রিট ল্যাংগুয়েজ অর্থাৎ রাস্তার ভাষাকে নাকি ‘ককি’ বলে। লন্ডনে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গরা এ ভাষায় বেশি কথা বলেন। আর এ ভাষা এ প্রজন্মের বাঙালি তরুণ-তরুণীরাও বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। কারণ এটি শুধু একটি বাচনভঙ্গিই নয়। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি এবং পোশাকও ম্যাচ করতে হয়। ইংরেজরাও এই ভাষাটা ভালোই বোঝে।

হোয়াইট চ্যাপেলকে সিলেটিপাড়া উল্লেখ করে আবদুর রহিম জানান, এখানে এলে ভারতীয় আর পাকিস্তারিনাই বেশি ঝালমুড়ি কেনেন। সন্ধ্যার পরে টেমসের পাড়ের বিভিন্ন দিকে চলে যান। সেখানেও ভালো বেচাকেনা হয়।

ফিরে আসার সময় আবদুর রহিম পাশের দোকান থেকে দৌড়ে কিনে নিয়ে এলেন পাপাডাম (এক ধরনের পাপড় ভাজা)। অনেক দিন পর বাংলায় কথা বলতে পেরে আবেগে আপ্লুত তিনি।

প্রতিক্ষণ/এডি/সুমন

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

December 2025
SSMTWTF
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031 
20G