অনেক মানুষের ভেতরে ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ থাকে

প্রকাশঃ নভেম্বর ১৩, ২০১৬ সময়ঃ ১২:৫৩ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:২১ অপরাহ্ণ

humayan-6

প্রশ্ন: আপনার উপন্যাস বাদশানামদারে পরাজিতের লেখা কোনো ইতিহাস উৎস হিসেবে ব্যবহার হয়নি?

হুমায়ূন: হবে কী করে? ইতিহাস কে লেখে জানো? যারা জয়লাভ করে, ইতিহাস সব সময় তারাই লিখে। বিজয়ের ইতিহাস লেখে। পরাজিতরা কখনো ইতিহাস লিখতে পারে না। পরাজিতরা কখনো ইতিহাস লেখার সুযোগ পায় নাই। এ সময়েই দেখো না, হিটলারের পক্ষে কোনো ইতিহাস লিখতে পেরেছে কেউ?
প্রশ্ন: বাংলা অঞ্চলের কোনো বীরকে নিয়ে কি আপনার কিছু লেখার ইচ্ছে আছে? উদাহরণ হিসেবে তিতুমীরের কথা বলা যায়। এঁদের নিয়ে তো কোনো লেখা হয়নি বললেই চলে।
হুমায়ূন: আমাদের কিশোরগঞ্জেই তো আছে। বীরাঙ্গনা সখিনা। ‘আউলায়ে খুলল কন্যা পিন্ধনের বেশ।’ আমার লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এগুলো খুবই আঞ্চলিক। বীরাঙ্গনা সখিনা, তিতুমীর বা ফকির-সন্ন্যাস বিদ্রোহ।
প্রশ্ন: লাতিন আমেরিকার মতো ভাবা যায়? লাতিন আমেরিকার লেখকেরা একটা চরিত্র খাড়া করে প্রতীকী উপস্থাপনের দিকে চলে যান। মানে, সরাসরি কথাটা না বলে, রূপকের মধ্য দিয়ে বলা। যেমন, মার্কেস লিখেছেন অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক। মানে, ওই সময়টাকে ঠিকই ধরেছেন উনি। কিন্তু চরিত্রগুলো তাঁর মতো করে বদলে নিচ্ছেন। আপনার হাত দিয়ে এ ধরনের একটা কাজ কি হতে পারত না?
হুমায়ূন: হ্যাঁ, নানাভাবেই ভাবা যায়। কিন্তু এতে যথার্থতার একটা সমস্যা থেকে যায়। যিনি যখনই কিছু বলছেন বা লিখছেন, তাঁর রাজনৈতিক পছন্দের বাইরে সাধারণত যেতে পারেন না। মার্কেসও পারেননি।
প্রশ্ন: আপনার রাজনীতির ব্যাপারে অনাগ্রহ, রাজনৈতিক লেখালেখিতে খুব সরব না, এর কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?
হুমায়ূন: আসলে, আমার দেখা প্রথম মানুষ তো আমার বাবা। উনি ইত্তেফাক-এর নাম দিছিলেন মিথ্যা-ফাঁক।
প্রশ্ন: আপনার ওপর বাবার যতটা প্রভাব, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর কিন্তু প্রভাব ততটা না।
হুমায়ূন: সে তো বাবাকে কম দিন দেখেছে, এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে আমার কাছে মানবিক সম্পর্ক রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। যেমন আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, নারী পুরুষের ভালোবাসার কথা বলুন। বলুন প্রেম কী? সংজ্ঞা দিন। আচ্ছা, প্রেম সম্পর্কে তোমাদের সংজ্ঞা কী এই সময়ে? এখনকার তরুণ-তরুণীরা কীভাবে?
প্রশ্ন: সংজ্ঞা আর কী? এটা একধরনের অনুভূতি। মানসিক অবস্থা।
হুমায়ূন: আমার সংজ্ঞাটা শোনো, প্রেম হচ্ছে ‘ভেতরে লুকিয়ে থাকা কিছু একটা।’ ধরা যাক, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলেটা মেয়েটার প্রেমে পড়েছে। মেয়েটা যখন সামনে আসবে, তখন ছেলেটার ভেতরে লুকিয়ে থাকা কিছু একটা বের হয়ে আসবে। তখন যেটা হবে, সেটা ইউফোরিয়া। একধরনের আনন্দ। সঙ্গে সঙ্গে গভীর বিষাদ, সে কতক্ষণ থাকবে। একটু পরেই তো সে চলে যাবে, তখন কী হবে! তারপর আবার কখন দেখা হবে? এই যে অনিশ্চয়তা, এর মধ্যে কিন্তু দারুণ এক আনন্দ আছে। প্রেমিকার কথা ভাবলে প্রেমিকের হূৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রেমিকা চলে যাবে, সে তো থাকবে না। এই বিষাদ, প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা; অর্থাৎ ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।’ যখন চলে গেল, ইউফোরিয়া শেষ। গভীর হতাশায় তুমি নিমজ্জিত। আবার যখন আসবে, লুকিয়ে থাকা জিনিসটা তখন আবার বেরিয়ে আসবে। এখন বলো প্রেমের রসায়ন সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কী?
প্রশ্ন: শারীরিক কিছু?
হুমায়ূন: এটাকে আরেকটু সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা যায়। তুমি কি একটা কুরূপা, দেখতে ভালো না। অসুন্দর, খাটো মেয়ের প্রেমে পড়বে? উল্টো ভাবেও ভাবা যায়, কুদর্শন পুরুষের প্রেমে কি একটি সুন্দরী মেয়ে পড়বে? আসলে অত্যন্ত রূপবতী কাউকে দেখলেই প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা তোমার বেশি। এর অর্থ হলো, প্রকৃতি চাচ্ছে, তার সন্তান-সন্ততি যেন সুন্দর হয়। এটা প্রকৃতির চাহিদা। প্রকৃতির একমাত্র লক্ষ্য এমন একটি প্রজাতি তৈরি করা, যেটি হবে অসম্ভব রূপবান, যেটি হবে অসম্ভব জ্ঞানী ও বুদ্ধিসম্পন্ন, যেটি হবে বিত্তবান। প্রকৃতি মনে করে এই বিশ্বকে বাসযোগ্য রাখার জন্য, সচল রাখার জন্য এটা জরুরি। নিরন্তর প্রকৃতি তার এই প্রক্রিয়া সচল রেখে চলেছে।
প্রশ্ন: কিন্তু অসুন্দর নারী-পুরুষের জীবনও তো একেবারে প্রেমহীন বলা যাবে না। তাদের প্রেমেও তো কেউ না কেউ পড়ে?
হুমায়ূন: হ্যাঁ, সেটা ঘটে। যৌবনে কুদর্শনও একভাবে আকর্ষণীয়। প্রকৃতি তার কথাও যে ভাববে না, এমন না। প্রকৃতি সেটাও ভাবে। অনেক সময় অনেক সুন্দরী মেয়েও অসুন্দর পুরুষের প্রেমে পড়ে। এতেও ভারসাম্য রক্ষা হয়। ওই জুটির ঘরেও সুদর্শন সন্তান-সন্ততির জন্ম হয়। এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে কিছু নয়। এভাবেও প্রকৃতি কাজ করে। চারপাশে তাকালে এটা বুঝতেও পারবে। এবং এটার মূলেও আছে কিন্তু ওই একই জিনিস। এটাও প্রেমের রসায়ন। এগুলো আমার কথা না সিরিয়াস গবেষণা করে এগুলো বের করা হয়েছে। এ রহস্য একদিনে উদ্ধার হয়নি।
প্রশ্ন: প্রেমের মতো স্রষ্টা নিয়েও আপনার ভাবনা আছে?
হুমায়ূন: আমি মনে করি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। আমি স্টিফেন হকিংয়ের একটা লেখা পড়লাম। প্রকৃতির মধ্যে কিছু নিদর্শন তো আছেই। তোমাকে একটা যুক্তি দিই, শোনো। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় যুক্তি। তুমি মঙ্গল গ্রহে গিয়েছ। সেখানে গিয়ে তুমি দেখলে পাহাড়, পর্বত, পাথর। পাথর দেখে তুমি বলবে, বহুকাল থেকে, সেই আদ্যিকাল থেকে পাথরগুলো এভাবেই আছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তুমি দেখতে পেলে একটা নাইকন ক্যামেরা। তুমি সেটা হাতে নেবে। তখন তোমাকে বলতেই হবে, এর একজন স্রষ্টা আছে। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে তুমি এ কথা ভাবতে পারবে না যে শূন্য থেকে এটা আপনা-আপনি এসে হাজির হয়েছে। কারণ, এটা একটা জটিল যন্ত্র। এবার, আরেকটু এগিয়ে গেলে। কোত্থেকে একটা খরগোশ বেরিয়ে এসে তোমার দিকে তাকাল। নাইকন ক্যামেরা কী করে? ছবি তোলে। খরগোশ কী করে? অনেক কাজই করে। খরগোশের একটা কাজ হলো দেখা। এই খরগোশের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জটিল। নাইকন ক্যামেরাটা দেখে তোমার যদি মনে হয় যে এর একটা নির্মাতা থাকা দরকার, তাহলে খরগোশের বেলায় এটা তোমার মনে হবে না কেন? আমার প্রথম যুক্তি যদি গ্রহণ করো, আমার দ্বিতীয় যুক্তিটাও তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিল এ রকম। অণু-পরমাণুতে ধাক্কাধাক্কির ফলে একটা জটিল অণুর জন্ম হয়েছে। একসময় এটা এত দূর জটিল হয়ে উঠছে, সেটা একেবারে নিজের মতো আরেকটা জিনিস তৈরি করতে শুরু করেছে। তারপর তৈরি হলো মানুষ। অসম্ভব ধীমান একটি প্রাণী। একটা গোলাপ ফুল দেখে যে মানুষ তারিফ করতে পারে, একটা পরম শৃঙ্খলা ছাড়া শুধু ধাক্কাধাক্কি করে কি এটা সম্ভব হতে পারে? এবং এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে অণু-পরমাণুর ধাক্কাধাক্কির ফলে আমরা গোলাপ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি? এই পৃথিবীর সবকিছু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে চলে। প্রোটন হবে ইলেকট্রনের চেয়ে ১,৮৩৬ গুণ বড়। সমস্ত তত্ত্ব, সংখ্যা ধ্রুব। এই ধ্রুবত্ব কে নির্ধারণ করেছে?
বিজ্ঞান কোনো বিষয় সম্পর্কে হুট করেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। তার একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। কিন্তু এই পদ্ধতি তো শুরু থেকে ছিল না। যেমন—অ্যারিস্টটল বলছিলেন, মানুষের মস্তিষ্কের কাজ হলো শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা। কথাটা অ্যারিস্টটল বলেছিলেন বলেই আমরা এক হাজার বছর পিছিয়ে গেছি। এখন বিজ্ঞান অনেক অদ্ভুত কথা বলছে। যেমন—মানুষের শরীরের মধ্যে যে ডিএনএ থাকে, তার মৃত্যু নেই।
তাই আমি মনে করি, আমরা এখনো খুব অল্প বিষয়ই জানতে পেরেছি। একজন পদার্থবিজ্ঞানীর পক্ষে রসায়ন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা সম্ভব না। জ্ঞানের পরিধি অনেক অনেক বড়। যুগে যুগে যেসব ধর্মপ্রচারক এসেছেন—তাঁরা কিন্তু একটা সামগ্রিক ধারণা রাখতেন জগৎ বিষয়ে। আল্লাহ তাঁদের কাছে সব সময় সরাসরি জ্ঞান দেন নাই। তাঁরা সব সময় যে সরাসরি ওহি পেয়েছেন তা তো না? জিবরাইল কি সব সময় সশরীরে এসে ওহি পৌঁছে দিয়েছেন? না। অনেক সময় শব্দের মাধ্যমে, অনেক সময় আলোর মাধ্যমেও ওহি পাঠানোর ব্যপারটা ঘটেছে। এ কারণে আমার মনে হয়, মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞানে সৃষ্টিকর্তাকে পুরোপুরি কখনো জানা সম্ভব না।
সৃষ্টিকর্তা মানুষের মতো এটা ধরে নিয়ে কিন্তু আমি চিন্তা করছি না। আমি চিন্তা করছি এমন একটা অস্তিত্ব নিয়ে, যে সর্বব্যাপী। তাকে আমরা আমাদের ক্ষুদ্র কল্পনাশক্তি দিয়ে কল্পনা করতে পারছি না। তিনি আমাদের কল্পনাসীমার বাইরে। অনেক সূরায় নানাভাবে এসেছে এ প্রসঙ্গ। সূরা এখলাসও এ বিষয়েই।
কিন্তু আমি সৃষ্টিকর্তাকে জানতে চাই। আমার নিজের জীবনে নানা ঘটনা বিভিন্ন সময়ে আমাকে ভাবিয়েছে।
প্রশ্ন: সেটা কেমন?
হুমায়ূন: নুহাশপল্লীতে একটা অংশ আছে যেখানে প্রচুর গাছগাছালি। ওদিকটায় কেউ যায় না, যেহেতু গাছগাছালি ছাড়া কিছু নাই। একবার এক দুপুর বেলা একা একা আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিছুই ভালো লাগছে না। এ সময় আমার প্রস্রাবের বেগ পেয়ে গেল। এখন ওখান থেকে হেঁটে ফিরে গিয়ে পেশাব করব? এখানে যেহেতু সুবিধাটা আছে…গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পেশাব করছি। অর্ধেকের মতো পেশাব করা হয়েছে, পেশাবের মাঝখানে খুব মিষ্টি একটা গলা, মেয়েদের গলা: এখানে এই কাজ করছেন? আমরা এখানে বেড়াই! আমার যা মনে হলো, যেহেতু মেয়ের গলা, আর পেশাবের মাঝখানে ঘুরে দাঁড়াতেও পারছি না। মনে হলো, প্রায়ইতো নুহাশপল্লীতে লোকজন ঘুরতে আসে—এদেরই কেউ হয়তো। তড়িঘড়ি পেশাব শেষ করে ঘুরে তাকালাম, দেখি কেউ নেই। কেউ না। আমি দৌড়ে বার হয়ে এসে খুঁজলাম, দেখলাম কোথাও কেউ নেই। তারপর আমি ম্যানেজারকে ডাকলাম: অর্ডার দিয়ে দিলাম এখানে কেউ যেন বাথরুম না করে। এবং দ্রুত কাছেই একটা টয়লেট তৈরির করার ব্যবস্থা করতে বলে দিলাম।
প্রশ্ন: এখন এই ঘটনাটার কী ব্যাখ্যা?
হুমায়ূন: না, এভাবে না। এর প্রথম ব্যাখ্যা হলো; ওটা ওই কোনো একটা এনটিটি, যাদের আমরা চোখে দেখি না। ওদের কেউ। এটা একটা ইজি ব্যাখ্যা। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা বলি: আমার সাবকনসাস লেবেল এই কাজটা পছন্দ করে নাই। সাবকনসাস লেবেল হয়তো চায় নাই আমি এই কাজটা করি, তাই নিজে নিজে একটা এনটিটি তৈরি করে তাকে দিয়ে আমাকে বলিয়েছে। শেষটাই আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।
প্রশ্ন: এ রকম ঘটনার মুখোমুখি আপনি আরও হয়েছেন?
হুমায়ূন: হ্যাঁ, অনেকবার। আরও একটা ঘটনা শোনো। তখন আমি মুহসীন হলে থাকি। আমার বড় মামা, তাঁর পড়াশোনা হলো মেট্রিক। নানা দেখলেন তাঁকে দিয়ে কিছুই করানো যাচ্ছে না, তখন উনাকে একটা ফার্মেসি করে দিলেন। গ্রামে যারা ফার্মেসি চালায় তারা কিন্তু প্রত্যেকেই ডাক্তার হয়ে যায়। কোয়াক। মামা কোয়াক ডাক্তার হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর এমন যশ হলো, ওই হাতুড়ে ডাক্তার ছাড়া আশপাশের এমবিএস ডাক্তারদের কাছে কেউ যায় না। মামা রোগী দেখছেন। এতে কখনো রোগী বাঁচছে, কখনো মারা যাচ্ছে। বেশ পয়সা হচ্ছে। তো আমাদের গ্রামের কাছেই একটা জঙ্গল মতো ছিল। একবার জঙ্গলের কাছ দিয়ে রোগী দেখে বাড়ি ফিরছেন মামা। বর্ষাকাল যেতে যেতে মামা এক সাপের গায়ে পা দিয়ে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে ফনা তুলে ফেলল সাপ। ভয়ংকর সাপ। মামা শুধু বলার সুযোগ পেল, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও আমি বাকি জীবন তোমার সেবা করব। সাপ ধীরে ধীরে ফনা নামিয়ে নিল। মামা পা তুলল, সাপটা চলে গেল। ফিরে আসার পর, তাঁর ডাক্তারি বিদ্যা শেষ, মামা সারা দিন শুধু আল্লাহকে ডাকেন। আমি বড় মামাকে বললাম, বড় মামা এই যে শুধু আল্লাহকে ডাকেন—এভাবে ডেকে কিছু কি পাইছেন? জবাবে মামা বললেন পাইছি। জিজ্ঞেস করলাম কী পাইছেন? আমি আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে একটা পর্যায়ে নিজেকে দেখতে পাই। দেখি আমি নিজের সামনে বসে আছি। আমি হেসে বললাম, এটা এমন আর কি! আয়না ধরলেই তো আমরা নিজেকে দেখতে পাই। মামা বললেন, এটা সে দেখা না—আমি দেখতে পাই আমি আমার সামনে বসে জিকির করছি। তখন আমার ইচ্ছে হলো এই লাইনে একটু ভেবে দেখা যায়।
প্রশ্ন: মানে আপনিও মামার মত শুরু করলেন?
হুমায়ূন: হ্যাঁ, মামাকে বললাম। মামা বলল, আল্লাহর একটা ডাকনাম তোমাকে শিখিয়ে দিই। এইটাই তুমি সব সময় জপ করবে, শুরুতে অল্প অল্প পারবে পরে দেখবে অভ্যস্ত হয়ে গেছো। কী নাম, নাম আল্লাহু, খুবই সরল। ঢাকায় ফিরে আসলাম। মুহসীন হলে থাকি। শুরুতে কখনো হয় আবার হয় না, প্রায়ই ভুলে থাকি। কিন্তু হঠাৎ করে যদি কোনো মাওলানা দেখি, কোনো দাড়ি-টুপির সৌম্য চেহারার লোক দেখি সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহু আল্লাহু করতে থাকি। এই শুরু হলো। এরপর অভ্যাস হয়ে গেল, তারপর দেখি সারাক্ষণ করছি। এটা কেমন হলো! চাইলেও থামাতে পারছি না। পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে যাই। পাবলিক লাইব্রেরিতে তখন খুব ভালো ভালো গল্পের বই ছিল। একদিন বই নিয়ে পড়ছি, পাশের টেবিল থেকে একজন এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, কী, আপনার সমস্যা কী? আমি যে সারাক্ষণই আল্লাহু আল্লাহু করছি, এটা আমি নিজেই আর বুঝতে পারছিলাম না। এটা যে সাউন্ড হিসেবে বাইরে চলে আসছে বুঝতে পারিনি। ক্লাসে গিয়ে এই ভয়ে একেবারে দূরে গিয়ে, একলা বসি। যাতে কেউ শুনতে না পায়। একদিন শিক্ষক এসে বললেন, কী ব্যাপার, তুমি একলা পেছনে বসে আছ কেন? আসো আসো সামনে এসে বসো। তখন আমি কঠিনভাবে চেষ্টা করি যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়। এদিকে রাত্রে স্বপ্ন দেখি একটা বিশাল ঘর, বহু লোকজন বসে আছে এবং প্রত্যেকেই আল্লাহু আল্লাহু করছে। চারদিকে শুধু একটা সাউন্ড হচ্ছে। এক লয়ের সাউন্ড হচ্ছে, চারদিকে। একসময় ঘুম ভেঙে যায়, আমি দেখি নিজেই আল্লাহু আল্লাহু করছি। বিষয়টা এতই কষ্টের হয়েদাঁড়ায়, ভাবি কীভাবে এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। আমার জীবন শেষ। প্রতি রাত্রেই এই ঘটনা। আল্লাহু আল্লাহু শব্দে ঘুম ভাঙে, দেখি আমি সিজদার ওপরে। ঘুম ভাঙে আবার ঘুম ধরে, এক রাতে চোখ খুলে দেখি, ঠিক আমার মুখের সামনে এক বিঘত দূরে একটা ফেস। ফেসটা মাথার সামনে চুল নাই, পেছনেও চুল নাই। কঠিন চেহারা, দাঁত নাই। হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার মনে হলো চোখে চশমা নাই, কী দেখতে কী দেখেছি। চোখে চশমা দেব, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব সময় চশমা হাতের কাছে রাখতাম। চোখে চশমা পরলাম, দেখি আছে। যেন ভেসে আছে মুখটা।
প্রশ্ন: শুধু ফেস না পুরো শরীরধারী?
হুমায়ূন: বলতে পারব না। অনেকে পরে জিজ্ঞেস করেছে ওটার শরীর ছিল কি না। আমি মনে করতে পারি নাই। চোখটা আবার বন্ধ করলাম। ভাবছি দিস ইজ এন্ড অফ মাই লাইফ। আই অ্যাম গোয়িং টু ডাই। সমস্ত শরীর দিয়ে পানির মতো ঘাম ঝরছে। তখন কেন যেন মনে হলো, কেউ যদি এই মুহূর্তে, আশপাশের কোথাও থেকে আজান দেয়, তাহলে জিনিসটা চলে যাবে। কিন্তু কে আজান দেবে। একবার মনে হলো আমি আজান দিই। কিন্তু দেখলাম আমি আজান জানি না। তারপর একমনে শুধু বলছি আজান-আজান। আজান। এভাবে বলতে বলতে ইউনিভার্সিটি মসজিদ থেকে আজান শুরু হয়ে গেল। আজান চলল। তারপর চোখ মেললাম, দেখি চলে গেছে। বহু কষ্টে দরজা খুলে পাশের রুমে গেলাম। পাশের রুমমেট মাওলানা মোহাদ্দেস পাস করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। অজু করে এসেছে। আমি তাকে বললাম, ভাই আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। আপনি কি আপনার নামাজটা আমার ঘরে পড়বেন? উনি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন না, বললেন অবশ্যই অবশ্যই হুমায়ূন। উনি নামাজ পড়লেন। আমি আর ক্লাসে গেলাম না। আমার সমস্ত শরীর ফুলে গেছে, সারাক্ষণ হাতের তালু আর পা চুলকাচ্ছে। বাবাকে খবর দেওয়া হলো। আব্বা নিজে এসে আমাকে হল থেকে নিয়ে গেলেন। এক মাস থাকলাম বগুড়ায়। এক মাস পর একটু সুস্থ হলে আবার হলে ফিরে এলাম। জীবনযাপন আবার শুরু হলো।
প্রশ্ন: কেন এমন হলো মামাকে আর জিজ্ঞেস করেননি?
হুমায়ূন: করেছি। পরে মামার ব্যাখ্যা ছিল আমি ভুল করেছি। এটা গ্যাপ দিয়ে দিয়ে করতে হতো। রং ওয়ে টু ডু। আমি সিরিয়াসলি নিইনি। মামার কথা ঠিক ছিল। যে কারণে আমি বিষয়টার জন্য আসলে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত ছিলাম।
প্রশ্ন: অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!
হুমায়ুন: অনেক মানুষের ভেতরে কঠিন ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ থাকতে পারে। যে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। আমি যদি দূর থেকে তাকে মনে মনে বলি আসসালামুয়ালাইকুম। তাহলে তার টের পাওয়া উচিত এবং সালামের জবাব দেওয়া উচিত। এটা একধরনের খেলা।
প্রশ্ন: আরেকটি ঘটনা?
হুমায়ূন: শোনো, হলো কি? আমি যাকেই দেখি মনে মনে বলি আসসালামুয়ালাইকুম। শীতের রাত শহীদ মিনার চত্বরে চা খেয়ে রওনা দিয়েছি। রোকেয়া হলের সামনে বড় রাস্তাটা ক্রস করতে হবে। আমার সঙ্গে ড. আতিকুর রহমান। এখন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে, গল্প করতে করতে রাস্তা পার হচ্ছি। যথারীতি অভ্যাসবশে প্রবীণ লুঙ্গি পরা খালি গায়ে এক লোক যাচ্ছে, অভ্যাসবশে সালাম দিয়ে বসলাম। আমরা রাস্তা ক্রস করে এপারে এসেছি—ওই লোক দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, এই শুনে যা! আমার বন্ধু আতিক খুব রেগে গেল। এত বড় স্পর্ধা! তুই করে বলছে! আমি থামালাম তাকে। লোকটা কাছে এগিয়ে এল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। এবার যা!
আমি তো স্তম্ভিত। ও মাই গড! এ তো সেই লোক, আমি এদ্দিন যাকে খুঁজছিলাম। এমন ভয় পেলাম আতিককে টানতে টানতে আমি হাঁটা দিলাম। দূরে এসে পেছনে ফিরে দেখি ওই লোক তখনো তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টে।

সূত্র: প্রথম আলো

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

April 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930  
20G