মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা শুরু
মানবতাবিরোধী অপরাধের বহুল আলোচিত মামলায় মতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা শুরু হয়েছে।আজ সোমবার দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের প্যানেল এ রায় ঘোষণা শুরু করেন। রায় সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
মামলাটি ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় প্রায় ১,৪০০ মানুষকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করার অভিযোগে দায়ের করা হয়। গত বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
অভিযোগ ও বিচার প্রক্রিয়া
এই মামলায় শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়—
১) রাজাকারের বাচ্চা বলে উসকানি ও গণহত্যায় প্ররোচনা
২) হেলিকপ্টার, ড্রোনসহ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশ
৩) রংপুরের ছাত্র আবু সাঈদ হত্যার দায় ও প্রমাণ গোপন করা
৪) চানখাঁরপুলে আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা
৫) আশুলিয়ায় ছয় আন্দোলনকারীর মরদেহ পুড়িয়ে নষ্ট করা
বিচারের পুরো প্রক্রিয়ায় ৫৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন, যাদের মধ্যে আহত ছাত্র, নিহতদের স্বজন, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ছিলেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো—সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী হয়ে নিজের দায় স্বীকার করেন এবং শেখ হাসিনা ও কামালের ভূমিকা আদালতে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
সাক্ষ্য ও আদালতে উপস্থাপিত তথ্য
সাক্ষীদের জবানবন্দিতে উঠে আসে—
•রাষ্ট্রীয় নির্দেশে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলি
•চোখ হারানো ও পঙ্গু হওয়া অসংখ্য তরুণের বর্ণনা
•নিহতদের পরিবারের আর্তনাদ
•গণহত্যার অডিও–ভিডিও ও বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন
প্রসিকিউশন জানায়, শেখ হাসিনার সরাসরি আদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা অডিও রেকর্ডিংসহ বিভিন্ন প্রমাণে নিশ্চিত হয়েছে।
দুই পক্ষের যুক্তি
প্রসিকিউশনের যুক্তি:
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম যুক্তিতর্কে বলেন—
“জুলাইয়ের গণহত্যার নিউক্লিয়াস ছিলেন শেখ হাসিনা। কমপক্ষে ১,৪০০ হত্যার দায় তাঁর ওপর বর্তায়। সর্বোচ্চ শাস্তি ছাড়া ন্যায়বিচার সম্ভব নয়।”
ডিফেন্সের বক্তব্য:
রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন—
“সরকার পরিচালনায় ভুল হতে পারে, কিন্তু হাসিনার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। আমি তাদের খালাস চাই।”
অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন—
“এই হত্যাযজ্ঞে অপরাধীরা শাস্তি না পেলে জাতি ভীরু বলে পরিচিত হবে। ভুক্তভোগীদের প্রতি অবিচার হবে।”
রায়ের আগে আদালত জানায়—
“ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, দুই পক্ষই তার প্রাপ্য অধিকার পাবে।”
অভিযোগ গঠনের পথ ও তদন্ত
২০২৪ সালের ১ জুন শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়।
মোট ২৮ কার্যদিবসে সাক্ষ্য–জেরা, অডিও–ভিডিও বিশ্লেষণ ও যুক্তিতর্ক শেষ হয়।
জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশজুড়ে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, গুম, নিপীড়ন ও আগুন–সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে।
পরবর্তী দুই মাসে ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ–১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ৫৬টি অভিযোগ জমা পড়ে।
এই অভিযোগের ৫৪টিতেই প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও তদন্তের অগ্রগতি
প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ও আরও ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে ১২ মে, যার ভিত্তিতে প্রসিকিউশন একাধিক মামলা করে এবং প্রথম মামলাটি বর্তমানে রায় পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি
রায় ঘিরে সারা দেশে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
আওয়ামী লীগ “লকডাউন” কর্মসূচি দিলেও বিএনপি–জামায়াত–এনসিপি পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
বিভিন্ন স্থানে আগুন দেওয়া, হামলা ও অবরোধের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
—————————-












