মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিশ্বনেতাদের উত্থান, পতন ও পরিণতি

প্রকাশঃ নভেম্বর ২৯, ২০২৫ সময়ঃ ৯:২১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:২১ অপরাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডেস্ক

গত বছরের জুলাই–আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল—যা তার শাসনামলেই গঠিত হয়েছিল। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এ রায় নিয়ে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে। এখন তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব কি না, সে নিয়েও বিতর্ক চলছে।

তবে শেখ হাসিনা একমাত্র উদাহরণ নন—ইতিহাসের নানা সময়ে বহু নেতাই নজিরবিহীন উত্থান, আলোচিত ক্ষমতার সময় এবং ঝড়ো পতনের পর মুখোমুখি হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডের মতো চরম পরিণতির।

ইতিহাস বলে, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র বা সামরিক শাসন—ক্ষমতার শীর্ষে থাকা অনেক শাসকই শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছেন নিজেদের দেশের আদালতের সামনে। কেউ সাজা ঘোষণার পর দ্রুত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, কেউ পালিয়েছেন, কেউ আবার পরে ক্ষমতায়ও ফিরেছেন।

ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস — রাজাও আইনের ঊর্ধ্বে নয়

ইউরোপে প্রথমবারের মতো প্রজাদের হাতে কোনো রাজার বিচার হয়েছিল ১৬৪৯ সালে। সংসদ ভেঙে ব্যক্তিগত শাসন, কর আরোপ ও ধর্মীয় সংস্কারের সিদ্ধান্তে চার্লস প্রথমের প্রতি জনরোষ বাড়তে থাকে। সংসদীয় বাহিনীর কাছে পরাজয়ের পর তাকে রাষ্ট্রদ্রোহে দোষী সাব্যস্ত করে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
তার মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যদিও পরে তা ফিরে আসে।

ফ্রান্সের লুই ষোড়শ — বিপ্লবে ধসে পড়া রাজতন্ত্র

১৭৭৪ সালে সিংহাসনে বসা লুই ষোড়শকে দুর্বল রাজা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, আর্থিক সংকট ও অভিজাতদের অনমনীয়তায় তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। বিপ্লব শুরু হলে তিনি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র মেনে নেন, কিন্তু পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে পরিচিত হন।
১৭৯৩ সালে গিলোটিনে তার মৃত্যুদণ্ড ফরাসি বিপ্লবকে আরও চরম পথে ঠেলে দেয়।

মেরি অ্যান্টোইনেট — বিলাসবহুল জীবনের মাশুল

অপব্যয়ী ও রাজকীয় আধিপত্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত রানী মেরি অ্যান্টোইনেটও বিপ্লবীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। বিদেশি শক্তির সাথে যোগসাজশের অভিযোগে বন্দী হওয়ার পর ১৭৯৩ সালে তাকেও গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
তার মৃত্যুর পর ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব আরও তীব্র হয়।

মেক্সিকোর সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান — বিদেশি শাসনের সমাপ্তি

ফরাসি সমর্থনে ক্ষমতায় আসা অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত ম্যাক্সিমিলিয়ান ফরাসি সেনা প্রত্যাহারের পর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন। ১৮৬৭ সালে রিপাবলিকান বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
এর পর মেক্সিকোতে জাতীয়তাবাদ ও প্রজাতন্ত্র আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট — মৃত্যুদণ্ড নয়, নির্বাসনই তার ভাগ্য

ইউরোপজুড়ে ফরাসি সামরিক আধিপত্য গড়লেও পরাজয়ের পর নেপোলিয়নকে এলবা ও পরে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত হতে হয়। অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড হলেও তা কার্যকর হয়নি। ১৮২১ সালে নির্বাসনেই তার মৃত্যু হয়।
তার প্রভাব আজও ইউরোপের আইন ও শাসনব্যবস্থায় বিদ্যমান।

সান ইয়াত-সেন — মৃত্যুদণ্ড এড়িয়ে বিপ্লবের নেতা

কিং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড পেলেও সান ইয়াত-সেন বিশ্বব্যাপী সমর্থন জোগাড় করে ১৯১১ সালের বিপ্লবে আধুনিক চীনের পথপ্রদর্শক হন।
তিনি প্রমাণ করেন, মৃত্যুদণ্ডের হুমকি সবসময় নেতৃত্বকে থামাতে পারে না।

ইয়াসির আরাফাত — মৃত্যুদণ্ড থেকে নোবেল পুরস্কার

১৯৭০-এর দশকে জর্ডানে সংঘাতের জেরে আরাফাতের বিরুদ্ধে অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়। তবুও তিনি পিএলও-এর নেতৃত্ব ধরে রাখেন এবং অসলো চুক্তিতে ভূমিকার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
রায় তাকে রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

বেনিতো মুসোলিনি — ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন

নাৎসি জার্মানির ঘনিষ্ঠ মিত্র মুসোলিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পতনের পর ধরা পড়েন। সংক্ষিপ্ত বিচারের পর তাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়, পরে মৃতদেহ প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
তার পর ইতালি ফ্যাসিবাদ থেকে সরে প্রজাতন্ত্রের পথে এগোয়।

চাউশেস্কু দম্পতি — রোমানিয়ার রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের সমাপ্তি

দীর্ঘ দমনমূলক শাসনের পর ১৯৮৯ সালের বিপ্লবে নিকোলাই ও এলেনা চাউশেস্কু ধরা পড়েন। সামরিক আদালত তাদের গণহত্যা ও দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
এই ঘটনার পর রোমানিয়া গণতন্ত্রের দিকে এগোতে শুরু করে।

সাদ্দাম হোসেন — পতনের পর বিভক্ত ইরাক

একনায়কতান্ত্রিক শাসন, যুদ্ধ ও দমনের জন্য বিতর্কিত সাদ্দাম হোসেন মার্কিন আগ্রাসনের পর আটক হন। দুজাইল হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ২০০৬ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
তার পতনের পর ইরাকে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ও সংঘাত আরও বৃদ্ধি পায়।

জুলফিকার আলী ভুট্টো — দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে আলোচিত বিচার

পাকিস্তানের ক্যারিশম্যাটিক নেতা ভুট্টোকে সামরিক শাসক জিয়াউল হকের আমলে বিতর্কিত বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রায়কে নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে।
তার মৃত্যুর পর পাকিস্তানে বেসামরিক–সামরিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়।
পরে তার মেয়ে বেনজির ভুট্টো দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভুট্টোর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

 

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G