চবি কলেজে নিয়ম বহির্ভূতভাবে রেজিস্ট্রারের ভাইকে অধ্যক্ষ নিয়োগের চেষ্টা
প্রতিক্ষণ বিশেষ:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের আপন ছোট ভাইকে নিয়োগের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রায় দীর্ঘ ১৩ বছর নিয়মিত অধ্যক্ষ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে চলতি বছরের ৯ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষসহ যাবতীয় শূন্যপদের জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে অধ্যক্ষ পদে মোট ২৭ জন প্রার্থী আবেদন করেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন মোহাম্মদ আবদুল কাইউম।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের ছোট ভাই।
গত ২৬ নভেম্বর অধ্যক্ষ পদের লিখিত, মৌখিক ও ক্লাস যাচাই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে ২৬ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেন। অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য এম এড বা সমমানের ডিগ্রী থাকার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা রেজিস্টারের ভাই আবদুল কাইউমের নেই।
এছাড়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর ন্যূনতম যোগ্যতা লিখা হয়েছিল, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের অধ্যক্ষ/উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষ/ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে কর্মরত। অথবা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক পদে ন্যূনতম ০৩ বছরের অভিজ্ঞতাসহ মোট ১২ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। অথবা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে/উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে জ্যেষ্ঠ প্রভাষকপদে ন্যূনতম ০৩ বছরের অভিজ্ঞতাসহ মোট ১২(বার) বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা।
কিন্তু রেজিস্টারের ভাই আবদুল কাইউমের এ অভিজ্ঞতাগুলো নেই বলে অভিযোগ করছেন অন্য আবেদনকারীরা। তারা বলছেন, আব্দুল কাইউম নারায়ণগঞ্জে একটি অনুমোদনহীন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এর আগে জেদ্দায় একটি মাধ্যমিক স্কুলে পড়ান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিক্ষার্থী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস থেকে যে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে সে বিজ্ঞাপনের শর্ত অনুসারে, মোহম্মদ আবদুল কাইউম অধ্যক্ষ পদে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার মতো যোগ্যতা পূরণ করতে পারেননি। কারণ যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল সেখানে বলা হয়েছিল ১২বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে এবং ৩বছরের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক অথবা অধ্যক্ষ পদে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। রেজিস্ট্রারের ভাই যে অভিজ্ঞতা দেখিয়েছেন সেই প্রতিষ্ঠান তো অবৈধ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কিংবা জেলা পরিষদের কোনো অনুমোদন নেই ঐ প্রতিষ্ঠানের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মোহম্মদ আবদুল কাইউম মূলত লায়ন এম কে বাসারের (শিক্ষাখাতে দূর্নীতি ও প্রতারণার দায়ে বর্তমানে জেলে তিনি) প্রতিষ্ঠিত ক্যামব্রিয়ান স্কুল এন্ড কলেজের নারায়ণগঞ্জ শাখার অধ্যক্ষ পদে কর্মরত। ক্যামব্রিয়ান কলেজ নারায়ণগঞ্জ শাখা একটি অননুমোদিত ক্যাম্পাস। এই ক্যাম্পাসের পাঠদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কিংবা জেলা পরিষদের কোনো অনুমোদন নেই। এই কলেজের নেই এডুকেশনাল ইন্সটিটিউট আইডেন্টিফিকেশান নাম্বার (EIIN)। পাঠ্য পরিচালনার কোনো অনুমোদন বাংলাদেশ সরকার ক্যামব্রিয়ান কলেজ, নারায়ণগঞ্জ শাখাকে প্রদান করেনি। এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবেও সরকারের কাছে নথিভুক্ত নয়।
বিভিন্ন সময়ে অবৈধ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে একুশে টেলিভিশন এবং যুগান্তরসহ নানা গণমাধ্যমে অসংখ্য রিপোর্ট হয়েছে। অথচ এই অবৈধ প্রতিষ্ঠানকে আবদুল কাইউমের অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এই পদের অন্যান্য প্রার্থীরা।
ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থীদের একজন জানান, যে প্রতিষ্ঠান নিজেই অবৈধ, সেই প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা কি করে বৈধ হয় ? রেজিষ্টারের ভাই হলেই তার জন্য কি সব শিথিল ? তাহলে আর নিযোগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পরীক্ষা নেয়ার এসব নাটকের কি দরকার ছিলো?
অধ্যক্ষ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া আরেক আবেদনকারী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় যে যোগ্যতার কথা সার্কুলারে উল্লেখ করেছিল, সেই অনুযায়ী মাত্র ৮ জন পরীক্ষায় অংশ নিতে পারতেন। কিন্তু আবেদন করেন ২৭ জন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের ভাই আবদুল কাইউমও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার যোগ্য নন। তাই তাকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে আবেদনকারী ২৭জনকেই পরীক্ষায় অংশ নিতে সুযোগ দিয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সে আমার ভাই। আমার ভাই হওয়ায় পরীক্ষা কমিটির মেম্বার হওয়া সত্ত্বেও বোর্ডে ছিলাম না। যেহেতু সে আবেদন করেছে সেহেতু আমি বোর্ড থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছি আগে থেকেই। আব্দুল কাইউম আমার ছোট ভাই, সে যদি ক্যামব্রিয়ান ছেড়ে এখানে আসে তাহলে সেটা তার জন্য বড় লস, চবি ল্যাবরেটরি কলেজের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি হবে। যদিও সে মনোনীত হয়েছে কি-না আমি জানি না, কারণ সিদ্ধান্ত সিলগালা করে রেখে দেয়া হয় সিন্ডিকেটের জন্য। আমি যদি বোর্ডে থাকতাম তাহলে জানতাম। সিন্ডিকেটে যেদিন খোলা হবে সেদিনই এটি জানা যাবে।’
এমএড কবে পাশ করেছেন বা সমমানের ডিগ্রি আছে কিনা এ বিষয়ে রেজিস্টারের ছোট ভাই আব্দুল কাইউমের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রতিক্ষণকে সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব দিতে পারেননি। তিনি শুধু বলেন, “যোগ্যতা পূরণ হওয়ায় আমি ইন্টারভিউ ফেস করেছি।”
তিনি আরো বলেন, ‘আমি জানি না কর্তৃপক্ষ কাকে নিয়েছেন, কিন্তু রেজিস্ট্রারের ভাই হওয়ার কারণে আমি পরীক্ষা দিতে পারব না- এটা বৈষম্য।’
পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার মতো যোগ্যতা না থাকার বিষয়ে আবদুল কাইয়ুম বলেন, “ এটা কর্তৃপক্ষের বিষয়। কাগজপত্র যাচাই ছাড়াতো আর পরীক্ষা নেয়া হয়নি।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে না জেনে আমি কিছু বলতে পারব না। ঐ নিয়োগের পরে আরো ৩-৪টা নিয়োগ হয়েছে আমি সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত আছি। যেটা হয়ে যায় সেটা ১-২দিন মনে থাকে।’
এ বিষয়ে জানতে উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।
নিয়োগ বোর্ডে থাকা আরেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীন বলেন, ’যারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে, তারা সকলেই সার্কুলার অনুযায়ী যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। এখন পর্যন্ত কারো কাছে নিয়োগের রেজাল্ট প্রকাশ করা হয়নি। কে নিয়োগ পেয়েছে এটা নিশ্চিত না হয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্টার অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, “দেখুন সকল নিযোগ বোর্ডে রেজিষ্ট্রার স্যার থাকেন। এখন পর্যন্ত তিনি কারো জন্য কোনও সুপারিশ করেননি। এবারই প্রথম তিনি তার ভাইয়ের নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করেছেন। তার একটি অনুরোধতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাখবেই। বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন প্লিজ।”
উল্লেখ্য, এর আগে সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করবার মতো যোগ্যতা না থাকায় তাকেও প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল এণ্ড কলেজের প্রভাষক পদে নিয়োগ দান করেন। পরবর্তীকালে নিজ সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে গিয়ে তিনি ল্যাবরেটরি কলেজের সকল শিক্ষককে ইন্সটিটিউট অব এডুকেশান এন্ড রিসার্চ এর শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করে নেন। এতে জটিলতা তৈরি হলে মারাত্মক সেশনজটে পড়ে ইন্সটিটিউট অব এডুকেশান এন্ড রিসার্চের শিক্ষার্থীরা।
proti/Adi/Ron














