কালের সাক্ষী ‘বিউটি বোর্ডিং’

প্রকাশঃ মে ২৪, ২০১৫ সময়ঃ ২:৪৭ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ২:৪৭ অপরাহ্ণ

buti bording 2একসময় পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত ছিল। কবি-সাহিত্যিকদের মিলন মেলা বসত এখানে। সহজেই জমে উঠতো সরস আড্ডা। সেই দিনগুলো কালের ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছে।

তবে বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐতিহ্য মনে করিয়ে দিতে এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে বোর্ডিংটির জরাজীর্ণ দোতলা ভবনটি। এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত মানুষগুলোর স্মৃতি। এখানে-সেখানে লেগে আছে তাদের স্মৃতিময় স্পর্শ। বাস্তবতা হলো, বিউটি বোর্ডিং আছে কিন্তু সেখানে প্রাণস্পন্দন আর নেই। কবি-সাহিত্যিকদের পদচারণা আজ আর নেই। এখন আর জমে উঠে না সরস আড্ডা।

বাংলাবাজারে বইয়ের মার্কেট পেরিয়ে শ্রীশচন্দ্র দাস লেনে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি জমিদার বাড়ি। এটির কোল ঘেঁষেই দোতলা একটি বাড়ি। ছোট লোহার গেট পেরোলেই ফুলের বাগান। বাগানের মাঝখানে দুর্বা ঘাসে মোড়ানো ফাঁকা জায়গা- আড্ডাস্থল। পাশেই অতিথিদের খাবারের ব্যবস্থা। হলদে-কালচে রঙের বাড়িটির এক কোনায় লেখা রয়েছে বিউটি বোর্ডিং।

১৯৪৯ সালের শেষের দিকে প্রহ্লাদ সাহা ও তার ভাই নলিনী মোহন সাহা তৎকালীন জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের কাছ থেকে ১১ কাঠা জমি নিয়ে তাতে গড়ে তোলেন এই বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে বিউটির নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে।

তখনকার সাহিত্য আড্ডার জন্য মুসলিম সুহৃদ সম্মিলনী, নবাববাড়ি, ঢাকা প্রকাশের কার্যালয়সহ অনেক জায়গা থাকলেও সবার পছন্দের জায়গা ছিল এই বিউটি বোর্ডিং। বাংলা সাহিত্যের অনেক দিকপালের পদচারণে এই বোর্ডিং ধন্য হয়েছে। সেসব ব্যক্তিত্ব নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছেন। শুরু থেকেই এখানে আড্ডা দিয়েছেন এ দেশের প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক, চিত্র পরিচালক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কিংবদন্তিরা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু ও পল্লীকবি জসিমউদ্দীন। এসেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিতে দিতেই অনেকের কলম হয়ে বেরিয়ে আসত বিখ্যাত কোনো লেখা বা কোনো মহৎ পরিকল্পনা। অনেকেই তাদের জীবনের সেরা অনেক লেখা লিখেছেন এই আড্ডায় বসে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে আড্ডা জমানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ নেন কবি বেলাল চৌধুরী ও শহীদ কাদরী। এরপর একে একে আসেন আরো অনেকে। এই আড্ডায় বসেই সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন তার বিখ্যাত সাহিত্যকর্মগুলো, যার মধ্যে অন্যতম আরণ্যক, অনুপম দিন, এক মহিলার ছবি, কয়েকটি মানুষের সোনালী ছবি, জনক ও কালো কফিন, সীমানা ছাড়িয়ে ও রক্ত গোলাপ। চলচ্চিত্র পরিচালক আব্দুল জব্বার খান এখানে বসেই লিখেছিলেন বিখ্যাত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর স্ক্রিপ্ট। ‘কাঁচের দেয়াল’-এর স্ক্রিপ্ট, সমর দাসের বহু বিখ্যাত গানের সুর এখানে বসেই করা। বিভিন্ন সময়ে এখানে আরো এসেছেন খালেদ চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কবি আল মাহমুদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ, ব্রজেন দাসসহ অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব।

প্রগতিশীল লেখকদের নিয়মিত আড্ডার জের ধরে বিউটি বোর্ডিং একাত্তরে হায়েনাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরের দৃষ্টিতে পড়ে যায় এটি। প্রগতিশীলদের হত্যা করতে প্রতিক্রিয়াশীল এই চক্র একাত্তরের ২৮ মার্চ সকাল ১০টার কিছু পর হঠাৎ অভিযান চালায় এখানে। বোর্ডিংয়ের মালিক প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা, সন্তোষ কুমার দাস, হেমন্ত কুমার সাহা, অহিন্দ চৌধুরী শংকর, প্রভাত চন্দ্র সাহা, নির্মল রায় খোকা বাবু, হারাধন বর্মণ, প্রেমলাল সাহা, কেশব দেউ আগরওয়ালা, শামস ইরানী, যোসেফ কোরায়া, শীতল কুমার দাস, অখিল চক্রবর্তী, সাধন চন্দ্র রায়, সুখরঞ্জন দে, ক্ষিতীশ চন্দ্র দে, নূর মোহাম্মদ মোল্লাসহ ১৭ জনকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা। পরে রাজাকারদের দখলে চলে যায় এটি। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় এটি বন্ধ থাকে। যুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রহ্লাদ সাহার দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহা দেশে ফিরে বিউটি বোর্ডিং পুনরায় চালু করেন।

বিউটি বোর্ডিংয়ে এখন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের আড্ডা বা পদচারণ নেই। এ অবস্থায় বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখাটাও হয়ে পড়ে ভাবনার বিষয়। এ অবস্থায় ১৯৯৫ সালে ইমরুল চৌধুরী গড়ে তোলেন ‘বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ’। তারই তত্ত্বাবধানে ১৯৯৮ সালে ৬০ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। এই বোর্ডের মাধ্যমে ২০০০ সাল থেকে সম্মাননা দেওয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে সম্মাননাপ্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী, কবি আল মাহমুদ, দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, কবি রফিক আজাদসহ বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক।

প্রহ্লাদ সাহার পর বোর্ডিংটির হাল ধরেছেন তার দুই ছেলে। বর্তমানে ভবনটিতে থাকার জন্য রয়েছে ২৫টি কক্ষ। এর মধ্যে ১২টি সিঙ্গেল ও ১৩টি ডাবল। সস্তায় খাওয়াদাওয়ার জন্য আছে সুব্যবস্থা। তার ওপর সংস্কৃতিমনাদের জন্য রয়েছে বিশেষ ছাড়।

বর্তমানে বাংলাবাজার থেকে বইয়ের ব্যবসা অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে থাকায় এখানে লোকজন কমে যাচ্ছে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এখানে লোকজনের সমাগম তুলনামূলক বেশি হয়। তার পরও পুরানো স্মৃতি ধরে রাখতে বোর্ডিংটি চালু রয়েছে। নতুন প্রজন্মের কবি-সাহিত্যিকদের পদচারণায় আবারও জমে উঠবে বিউটি বোর্ডিংয়ের সেই সরস আড্ডা। প্রাণ ফিরে পাবে ইতিহাস ঐতিহ্যের বিউটি বোর্ডিং- সংশ্লিষ্টদের এমনটাই প্রত্যাশা।

প্রতিক্ষণ/এডি/নির্ঝর

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G