দি টেক ব্লাইন্ড জেনারেশন

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৫ সময়ঃ ১২:৪৪ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:৫১ অপরাহ্ণ

Fazlu-2“কম্পিউটারে অনেক কাজ করা যায় বটে। তবে সব নয়। আর কম্পিউটারে করার দরকারই বা কী? আমার কাজের জন্য কম্পিউটার দরকার হয় না। আমি জীবনে কখনো ক্যালকুলেটর ব্যবহার করিনি৷ এই বিষয়ে আমি গর্বিত নই, লজ্জিতও নই। মাথা খাটিয়ে করলেই তো হয়। তাতে মস্তিষ্কের চর্চাও হয়, নিজে নিজে করাও হয়।”-বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম।

এই মহাগুনীজনের বাসায় টেলিভিশনও ছিল না। ইন্টারনেট তাঁকে টানেনি কখনো। আধুনিক আতিশায্যে থেকে থাকতেন দূরে। একটা মোবাইল ব্যবহারে নিতেন কেবল ‘হাই, হ্যালো, ইয়েস, নো, ভেরিগুড’-এর বাহন হিসেবে। তাহলে এভাবেও জীবন গড়ে মহাজ্ঞানী হওয়া যায়!

এরপরও এই যুগে-সকালে জানালা খুলে আকাশ দেখার আগে আমরা দেখছি প্রযুক্তি। বেডরুম টু অফিসরুম-সবই প্রযুক্তির দখলে। এখন ব্যাচেলরের ঘর সাজানো-গোছানো থাকলে বুঝতে হবে, তার কম্পিউটার কাজ করছে না! এমন দিনও হয়তো আসবে, যখন গুগলকে ‘আমার মোজাজোড়া কই?’ জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যাবে, ‘ডিভানের তলায়!’ সকলই এখন ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস-সব কটিতে অ্যাকাউন্ট নিয়ে ব্যস্ত। বিনিময়ে হারিয়ে ফেলছে ‘জীবন’।

যে ফুটবলে লাথি দিয়ে বেড়ে উঠেছিল আমাদের জীবন সে ফুটবলের ব্যবহারবিধি খুঁজে বেড়ায় এ যুগের প্রযুক্তি প্রজন্ম। যুক্তি-তর্ক-গল্পে এখন গলায় চাপ পড়ে না, ব্যথায় কুকরায় কেবল আঙ্গুল, কারণ চ্যাটিংয়ের চাপ যাচ্ছে হাতের এই অগ্রঅংশে! প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির এই ধারা অক্ষন্ন থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই তিন ঘণ্টায় আমাদের পৃথিবীর চারপাশ প্রদক্ষিণ করে বাসায় ফিরে আসা সম্ভব হবে। পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে লাগবে এক ঘণ্টা। বাকি দুই ঘণ্টা ব্যয় হবে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরতে!

যে সময়টা জগত চেনার, সে সময়টায় সবাই জগত ছেড়ে ইন্টারনেটে মত্ত। সময় নেই মুখোমুখি বসিবার, দু’দন্ড সুখ-দু:খের কথা কহিবার। পাশের ফ্ল্যাটের সাথেও কথা হয় মোবাইলে, ঘর হতে দু’পা ফেলার ফুরসত নেই যেন আর! প্রযুক্তির সঙ্গে বসবাসের শেষ কোথায়? এই ‘টেক ব্লাইন্ড জেনারেশন’-এর গন্তব্য জানা আছে কি?

বুদ্ধিমত্তার দিকে থেকে এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ। একুশ শতকে মানুষের বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষতা চরমে পৌঁছেছে। লাখ লাখ হিসাব কষছে, মঙ্গলে যাচ্ছে, অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে অন্য কোনো গ্রহে বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে মানুষ। এর চেয়ে বড় উৎকর্ষতা কী আর হতে পারে।

কিন্তু দুঃসংবাদ হচ্ছে, এই বুদ্ধিমান প্রাণীটি খুব কম সময়ের মধ্যেই নির্বোধতম প্রাণীতেও পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কয়েকজন বিজ্ঞানী এমনই দাবি করেছেন।

সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা চালান একদল বিজ্ঞানী। সেই গবেষণার ফল বলছে, মানুষের মেধা ও বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ) সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছে। আর বৃদ্ধির কোনও সম্ভাবনা নেই। বরং এবার তা নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। এবং একটা সময় মেধা একেবারেই লোপ পাবে। মস্তিষ্ক ফের আদিম গুহাবাসী মানুষের মতোই হয়ে যাবে।

এশিয়া থেকে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র সব মহাদেশেই এই প্রবণতা দ্রুত শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধির হার সব থেকে বেশি হয়েছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। দুঃখের বিষয় আশি সালের পর থেকে প্রত্যেক দশকে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ৩ পয়েন্ট করে কমেছে।

সংগৃহীত উপাত্ত বলছে, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক এবং অস্ট্রেলিয়ার মানুষদের আইকিউ গত এক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ডেনমার্কে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার যোগ্যতা যাচাইয়ের এক আইকিউ টেস্টে দেখা গেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত মানুষের আইকিউ ১.৫ শতাংশ কমেছে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াতেও একই ফলাফল পাওয়া গেছে। নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন লিখেছেন সাংবাদিক বব হোমস।

যুদ্ধপরবর্তী জাপান ও ডেনমার্কে আইকিউ বেড়েছিল। এই বৃদ্ধি প্রব্ণতাকে ‘ফ্লিন প্রভাব’ বলে। ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমন ফ্লিন বলেছিলেন, খবাবের পুষ্টিমান বাড়া এবং জীবনযাত্রার উন্নতি ও শিক্ষার সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার উন্নতি সম্পর্কিত। এ থেকেই ওই প্রবণতাকে ‘ফ্লিন প্রভাব’ বলে।

তবে একুশ শতকে এসে ফ্লিন প্রভাবের উল্টোটা ঘটছে বলে দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা। যদিও ফ্লিনসহ কিছু বিজ্ঞানী দাবি করছেন, শিক্ষার উন্নতির সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য বুদ্ধিমত্তার এই অবনতি ঘটতে পারে। তবে এটা খুবই সাময়িক। অবশ্য অন্য বিজ্ঞানীরা তাদের মতো মোটেই আশাবাদী নন।

অনেকে মনে করেন, ফ্লিন প্রভাব অনেকটা বংশগতির ব্যাপার। উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা কম সন্তান নেন। একারণে ক্রমেই বিশ্বে বুদ্ধিমান মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ববিদ রিচার্ড লিন মানুষের জিনের সক্ষমতা কমে যাওয়ার হার হিসাব করে দেখিয়েছেন। তিনি দেখেছেন, ১৯৫০ এবং ২০০০ সালের মধ্যে মানুষের বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ) কমেছে এক পয়েন্ট। লিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এই প্রবণতা অব্যহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে মানুষ আরো ১.৩ পয়েন্ট আইকিউ হারাবে।

বেলজিয়ামের ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলসের অধ্যাপক মাইকেল উডলি দাবি করেন, ভিক্টোরীয় যুগের চেয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া অনেক ধীর গতির। কারণ, মানুষের জিনগত সক্ষমতা কমে গেছে।

আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক জ্যাঁ তি নিজেনহিস বলেন, পশ্চিমারা ভিক্টোরীয় যুগের পর থেকে এ পর্যন্ত গড়ে ১৪ পয়েন্ট আইকিউ হারিয়েছে। তিনিও বিশ্বাস করেন, শিক্ষিত বুদ্ধিমতি নারীরা কম সন্তান নেয়ার কারণেই এটি ঘটছে।

মানুষের বুদ্ধিমত্তা কমার জন্য আধুনিক জীবন-যাপনের বদঅভ্যাসকেও দুষছেন অনেক বিজ্ঞানী। তাদের মতে, বর্তমান বিশ্ব এতটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে যে, মানুষ চিন্তা-ভাবনা করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। এর জেরে, মানুষের বুদ্ধির বিকাশ কমছে…।

ও, তাহলে এই কথা! বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম তো এমনিতেই প্রযুক্তি থেকে দূরে ছিলেন না!!

বর্তমানে আমরা দেখছি- নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তি নির্ভর। ২০/৩০ বছর আগে যেভাবে চিন্তা-চেতনা চলতো এখন ছেলে মেয়েরা সেভাবে চিন্তা করে না। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা আলাদা,প্রযুক্তি নির্ভর। অনেকে মনে করেন, বর্তমান প্রজন্মের চিন্তাশক্তি কমে যাচ্ছে। তারা সহজে সবকিছুর সমাধান পেয়ে যাচ্ছে বিধায় চিন্তা করতে হচ্ছে কম। ক্যালকুলেটর, স্মার্টফোন থাকাতে এখন ছেলেমেয়েরা জটিল হিসাব-নিকাশগুলো চিন্তা ছাড়াই করে ফেলতে পারছে। মস্তিষ্কের প্রয়োগ কম হওয়াতে তাদের বুদ্ধির বিকাশ হচ্ছে না।

তবে অন্য যুক্তিও আছে-বর্তমান প্রযুক্তি আমাদের এত বেশি কিছু দিয়েছে যে- আমরা চিন্তা করতে গেলে কূলকিনারা পাই না। ক্যালকুলেটর আর ফোন থাকাতে এখন আর বড় বড় সংখ্যার হিসাব মনে মনে করতে হয় না, মনে রাখতে হয় না কোন বড় সংখ্যা। এর মানে এই নয় যে ছেলেমেয়েরা তাদের মস্তিষ্ক ব্যবহার করছে না। এটা প্রযুক্তির আশীর্বাদ যে এখন তারা এগুলোর ব্যবহার করতে পারছে এবং অন্য কোনো জটিল বিষয়ে মাথা খাটাতে পারছে। জ্ঞানী হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা প্রযুক্তির। প্রযুক্তি কেনোভাবেই একজন মানুষের বুদ্ধিমত্তা লোপ করতে পারে না বরং ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় বুদ্ধিকে বিকশিত করে।

বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলামের ঘনিষ্টজন, আরেক বিজ্ঞান বিস্ময় স্টিফেন হকিং এর উদাহরণ। প্রযুক্তিই তো সচল রেখেছে এই ‘বিগ ব্যাং’ প্রবক্তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাকা!

তাহলে আসুন- আপাতত দুটি যুক্তিই মেনে নিই। প্রযুক্তির অপব্যবহারের জন্য আমরা বিজ্ঞানকে দায়ী করতে পারি না। এর জন্য দায়ী প্রযুক্তির অপপ্রযোগকারীর কর্মকান্ড। কারণ একই অস্ত্র খুনীর হাতে যা করতে পারে ডাক্তারের হাতে তা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধিত হয়। এতে তো অস্ত্রের কোন দোষ নেই।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগে সারা বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। বিশ্বে ঘটে যাওয়া যে কোন বিষয় মানুষ মুহূর্তের মধ্যে জেনে যাচ্ছে। গুগলের মত সার্চ ইঞ্জিনের বদৌলতে মানুষ নতুন-পুরানো অনেক তথ্যই সহজে পেয়ে যাচ্ছে হাতের নাগালে। প্রযুক্তি তো এখন নিত্যসঙ্গী। তাহলে তো নি:সঙ্গতা অন্তত: কেটে যাচ্ছে। গলদ, হ্যা গলদ এখানেও। একটু খতিয়ে নেয়া যাক গলদ কান্ডটি।

বাস্তব জীবনে মানুষ নানা কারণে স’ান, কাল ও পাত্রভেদে নিজেকে অসহায় যেমন মনে করে তেমনি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম প্রভৃতি হতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। একাডেমিক প্রত্যয় হিসেবে এটি কার্ল মাক্স ব্যবহার করেন আজ থেকে বহু বছর আগে। তিনি মূলত পুঁজিবাদী সমাজের শ্রমিক শ্রেণির বিচ্ছিন্নতাকে বুঝাতে পদটি ব্যবহার করেন। বৈজ্ঞানিকভাবে তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে পুঁজিবাদী কাঠামোতে শ্রমিক নিজের শ্রম, উৎপাদিত পণ্য এমনকি নিজের সঙ্গী-সাথী থেকে বিচ্ছিন্ন হয় পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় শ্রমিক নিজের সত্তা থেকে যেমন বিচ্ছিন্ন হয় তেমনি পরস্পর থেকেও বিচ্ছিন্ন হয় বলে তিনি মনে করেন।

বর্তমানের প্রাযুক্তিক দুনিয়ায় আমরা মহামতি কার্ল মাক্সের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বটি এডিয়ে যেতে পারি না। এখন মানুষ হয়ে পড়েছে প্রযুক্তির গোলাম! প্রযুক্তি কি মানুষকে নিকটবর্তী করছে নাকি দূরে ঠেলে দিচ্ছে এটা বহুল বিতর্কের বিষয়। মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ছে। দূরত্ব কমছে। ফলে সমাজবদ্ধ মানুষ পরস্পরের নিকতবর্তী হচ্ছে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আসলে কি তাই? প্রযুক্তি কি মানুষকে কাছে টানছে নাকি দূরে ঠেলে দিচ্ছে?

একটু গভীরে গেলেই দেখা যায়, প্রযুক্তি মানুষকে যে হারে নিকটবর্তী করছে তার থেকে বেশি দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষকে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে সাধারণত মানুষ বাস্তববাদী হয়ে থাকে। আবেগ, অনুভূতি, বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত ভাবাবেগের পরিবর্তে তারা যৌক্তিক আচরণের উপর গুর্ত্বু দিয়ে থাকে। মানুষকে সারাক্ষণ যান্ত্রিক অবয়বেই থাকতে হয়। কেননা প্রযুক্তি মানে যান্ত্রিকতা। তাই যন্ত্রের সাথে থাকতে থাকতে তাদের জীবনও অনেকটা আমাদের মত গতানুগতিক ধারার বাইরে যান্ত্রিক ধরনের হয়ে থাকে।

বর্তমান সময়ে এসে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের ফলে মানুষ বাস্তববাদী হওয়ার সাথে কৌশলী ও যান্ত্রিকও হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ হিসেবে মানবীয় সত্তা থেকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবাদে মানুষ তার আশ-পাশের মানুষের পরিবর্তে দূরের মানুষের সাথে যোগাযোগ করছে।

এখন মোবাইল চ্যাট, ফেইজবুক, টুইটার, স্কাইপি প্রভৃতি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক যোগাযোগের স্থান দখল করে নিচ্ছে যান্ত্রিক যোগাযোগ। নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব ও আড্ডা দেয়ার পরিবর্তে আড্ডা দিচ্ছে দূরের মানুষের সাথে। কাছের মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে দূরের মানুষকে কাছে পাওয়ার চেষ্টাও চলে। সামাজিক মেলামেশার চেয়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে কেটে যাচ্ছে বেলা। এতে করে মানুষ ব্যক্তিসত্তা ও সঙ্গী-সাথী উভয় থেকেই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রসার বাড়ার সাথে সাথে মানুষ কাছের মানুষ থেকে যেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তেমনি দূরের মানুষদের কাছে না পাওয়ার বেদনা তাকে তাড়া করছে। এ বেদনাও তাকে স্বীয় সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। কার্ল মার্কস এখন বেঁচে থাকলে হয়ত পুঁজিবাদী সমাজের বিচ্ছিন্নতাবোধের কথা না বলে প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের বিচ্ছিন্নতাবোধের তত্ত্বই আমাদে সামনে তুলে ধরতেন।
প্রযুক্তির অগ্রগতির অন্যতম পদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

সাত বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে আসক্তি গড়ে উঠেছিল টিনএজারদের, আজ তাদের অনেকেই আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন। এক ব্রিটিশ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। যে সব টিনএজাররা সোশাল মিডিয়ায় বহু দিন ধরেই আসক্ত তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বিষয়টি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০০৭ সালে বিজ্ঞানীরা ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। এদের সবার বয়স ১৪-১৫ বছরের মধ্যে ছিল। তারা তখন সবাই নিজেদের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বর্তমানে ওই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ মেয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন। আর ছেলেদের মধ্যে ৫০-৫৫ শতাংশ এ সমস্যায় ভুগতে থাকেন।

গবেষকরা সাবধান করে দিয়েছেন যে, টিনএজাররা অনলাইনে তাদের ব্যক্তিগত জীবনসহ অন্যান্য বিষয় উন্মুক্ত করে দেয় যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর এসব কারণেই আত্মবিশ্বাস উধাও হয়ে যায় তাদের মাঝ থেকে।

তারপরও উপসংহারে সেই ‘ছুরি’ তত্ত্বকেই আমরা মানতে বাধ্য হচ্ছি। প্রযুক্তি যেমন ‘কুশল’ বিনিময়ের সামাজিকতার বদলে ‘তথ্য’ বিনিময়ের যান্ত্রিকতাকে প্রাধন্য দিচ্ছে ঠিক তেমনি মার্কিন মুল্লুকের মাইকেলে সাথে বঙ্গের রাম-রহিমদের মিলিয়ে দেয়ার বিরল সুযোগ করে দিচ্ছে। যুগের চাহিদানুসারে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে।

এ অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য। প্রযুক্তির এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা যেমন দরকার তেমনি জীবনে দূরের মানুষদের সাথে যান্ত্রিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের পরিবর্তে নিকটের মানুষদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও সম্পর্ক যাতে ঠিক থাকে সেই দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। তাহলেই জীবনকে ভোগের পাশপাশি উপভোগও করা যাবে। জীবন হয়ে উঠবে আরও বেশি আনন্দময়, মায়া-মমতায় সিক্ত।
আমরা জানি কোনোকিছুর অতিরিক্ত ভালো না।

কোনোকিছুতে ‘প্রয়োজন’-এর বদলে আসক্তি এসে গেলে তা কখনো ভালো ফল বয়ে আনে না। একজন যদি প্রযুক্তির নেশায় মত্ত হয়ে থাকে, এই বিষয়ে তার আসক্তি দেখা দেয় তাহলে তা কখনই স্বাভাবিক নয়। তবে এই প্রযুক্তি আসক্তি ব্যক্তির দোষ, প্রযুক্তির দোষ নয়। কোন কিছু আসক্তির পর্যায়ে চলে গেলে সেটা ‘অসুস্থতা’। অসুস্থতা মানেই তো স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্ছিন্নতা। তাই প্রযুক্তির ভালো দিকটা খুঁজে বের করতে হবে। সেভাবে ব্যবহারবিধি গড়তে হবে।

অবশেষে চলুন, এবার প্রযুক্তি ও জীবনকে মেখে দেখি এই গল্পে-

একটি গাছ। নদীর পাশে সবুজ সুডৌল ডুমুর গাছ। ছোট নদী-বৈশাখ মাসেও হাঁটুজল থাকে। সেই জলে মাছের খেলা। কখনো সেই খেলা দেখতে দেখতে বেলা কাটানো যায়। কখনো খেলার ছলে মাছদের বড়শিতে গেঁথে নিজের খাবার করা যায়। ফুরফুরে মনে সেই বড়শি কাজে নামলেন সুখী এক মানুষ। পরণে আরামের ছড়াছড়ি। গাছের শিকড়ে বসেছেন তিনি। নদীর জল ছোঁয়া বড় সেই শিকড়টায় বসা। পায়ের উপর পা। মুখে গুনগুনা গুন গানের হাওয়া। মাছ ধরছেন, আর আহ্লাদে আটখানা হচ্ছেন। সুখের চিহ্ন সবখানে। সেখানে হাজির এক আগন্তুক। এল নতুন তরিকা তার তরফ থেকে। বলা শুারু করলেন নতুন যে জন-
‘আপনি তো এর চেয়ে ভালো উপায়ে মাছ ধরতে পারেন, আরো আয়েশে দিন কাটাতে পারেন।’
-কিভাবে?
‘এই যে আপনি বড়শিতে ধরছেন মাছ। টুকটুক-টুকিটাকি। অনেক সময় লাগে। একটা ভালো জাল কিনলে আপনি এক সাথে কম সময়ে অনেক মাছ ধরতে পারেন।’
-অনেক মাছে কি হবে?
‘অনেক লাভ হবে, একটা নৌকা কিনবেন, নিজে খাবেন, বাজারেও বিক্রি কবেন। এরপর রাশি রাশি টাকায় বাড়ি-গাড়ি করবেন। সুখে-শান্তিতে দিন কাটাবেন।’
-সুখে শান্তিতে?
‘হ্যা, তাই -বাড়ির লনে বসে দখিনা হাওয়া খাবেন, গুনগুনিয়ে গান করবেন, সুখ সুখ প্রহরে নাচাবেন পা।’
-ও তাই! আমি তো এখনো তাই করতে পারছি, দেখেন-তাই করে যাচ্ছি। আরামে বসে দখিনা হাওয়া খাচ্ছি, সুখের গান গুনগুনিয়ে পা নাচিয়ে যাচ্ছি! আমার সুখের কি অভাব? এর চেয়ে বেশি শান্তি তো দরকার নেই!…

লেখক: ফজলুর রহমান , সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ),  চুয়েট

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G