ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন: ছাত্রদলের ভরাডুবি ও শিবিরের অগ্রযাত্রা

প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫ সময়ঃ ১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:৫৩ পূর্বাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডেস্ক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিচ্ছবি।

সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (ছাত্রদল) বড় ধরনের ভরাডুবির শিকার হয়েছে, অন্যদিকে ইসলামী ছাত্রশিবির (শিবির) তুলনামূলকভাবে নিজেদের উপস্থিতি দৃঢ় করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই ভরাডুবির পেছনে সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের বিভাজন, দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতি এবং শিক্ষার্থীদের আস্থা হারানো প্রধান ভূমিকা রেখেছে।

নির্বাচনী ফলাফল:

ডাকসু

ভিপি পদে ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৫,৭০৮ ভোট। বিজয়ী হয়েছেন শিবির-সমর্থিত প্যানেলের সাদিক কায়েম, ভোট ১৪,০৪২।

জিএস পদে ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম পেয়েছেন ৫,২৮৩ ভোট। বিজয়ী হয়েছেন একই প্যানেলের এস এম ফরহাদ, ভোট ১০,৭৯৪।

জাকসু

ভিপি পদে ছাত্রদলের শেখ সাদী পেয়েছেন ৬৪৮ ভোট। বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র সম্মিলন প্যানেলের আব্দুর রশিদ জিতু, ভোট ৩,৩৩৪।

জিএস পদে ছাত্রদলের তানজিলা হোসাইন বৈশাখী পেয়েছেন ৯৪১ ভোট। বিজয়ী হয়েছেন শিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের মাজহারুল ইসলাম, ভোট ৩,৯৩০।

ছাত্রদলের ভরাডুবির কারণ–

 সাংগঠনিক দুর্বলতা ও স্থবিরতা

দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। কেন্দ্র থেকে শুরু করে শাখা পর্যায় পর্যন্ত সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। যে কারণে তৃণমূল পর্যায়ে সক্রিয়তা ছিল না, ক্যাম্পাসভিত্তিক শক্তি গড়ে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো ধারাবাহিকভাবে কমিটি ও কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে, ফলে তারা ভোটের সময় একতাবদ্ধভাবে প্রচারণা চালাতে পেরেছে।

 নেতৃত্ব সংকট ও বিভাজন

ছাত্রদলের মধ্যে নেতৃত্বের সংকট দীর্ঘদিন ধরেই প্রকট। যোগ্য নেতা বাছাইয়ের পরিবর্তে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে দল বারবার জর্জরিত হয়েছে। এতে কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন, মাঠে সক্রিয় থাকার মানসিকতা হারিয়েছেন। নির্বাচনের সময় এই বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে—একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ প্যানেল গঠন করতে ছাত্রদল ব্যর্থ হয়েছে।

 ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতি

ডাকসু ও জাকসু—দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের উপস্থিতি নেই। তাদের কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন, শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি বা একাডেমিক সমস্যায় কার্যকর হস্তক্ষেপ চোখে পড়েনি। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিয়মিত মিছিল, আলোচনা সভা ও সামাজিক কর্মসূচি চালিয়েছে, সেখানে ছাত্রদল কার্যত নিষ্ক্রিয় থেকেছে। এই অনুপস্থিতিই ভোটে তাদের পিছিয়ে দিয়েছে।

জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন
বিএনপির দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থান ছাত্রদলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মূল দলের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও অসংগতি শিক্ষার্থীদের আস্থা হারিয়েছে।

ইমেজ সংকট এবং  শিক্ষার্থীদের আস্থাহীনতা

অতীতে সহিংস কর্মকাণ্ড, অস্ত্রবাজি ও অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে ছাত্রদলের প্রতি অনেক শিক্ষার্থীর আস্থা কমে গেছে। নতুন প্রজন্ম তাদেরকে আধুনিক রাজনীতির প্রতিনিধি হিসেবে দেখছে না।

শিক্ষার্থীরা মনে করেন, ছাত্রদল আর তাদের স্বার্থের প্রতিনিধি নয়। অতীতে সহিংস রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং বর্তমানে নিষ্ক্রিয় থাকা—এই দুইয়ের কারণে নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তরুণ ভোটারদের বড় অংশ ছাত্রদলকে বিকল্প শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেনি। ফলে প্রার্থীরা যথেষ্ট ভোট পাননি।

 প্রতিদ্বন্দ্বীদের শক্তিশালী প্রচারণা

শিবির-সমর্থিত এবং বামপন্থী প্যানেলগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী প্রচারণা চালিয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের কাছে সুস্পষ্ট দাবি ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে। ভোটের আগেই প্রতিটি হলে ও ডিপার্টমেন্টে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু ছাত্রদলের প্রচারণা ছিল সীমিত, স্বল্পসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সীমাবদ্ধ। ফলে ভোটের মাঠে তারা পিছিয়ে গেছে।

অর্থ ও লজিস্টিক ঘাটতি
প্রচারণা, পোস্টার, লিফলেট, ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ— সব ক্ষেত্রেই ছাত্রদল পিছিয়ে ছিল। আর্থিক দুর্বলতা ও সংগঠনের অনিয়মিত কার্যক্রম তাদের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতাকে কমিয়েছে।

শিবিরের এগিয়ে যাওয়ার কারণ-

শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন
ইসলামী ছাত্রশিবির দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের সংগঠনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখার জন্য পরিচিত। প্রতিটি ইউনিট থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত শৃঙ্খলা বজায় রাখায় তারা ভোটের সময় শক্ত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে।

ক্যাম্পাসে সক্রিয়তা
সরকারি চাপ থাকা সত্ত্বেও শিবিরের কর্মীরা ক্যাম্পাসে ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় থাকে। পাঠচক্র, সাংগঠনিক সভা ও গোপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রভাব ধরে রেখেছে।

ধারাবাহিক আদর্শিক প্রচার
শিবিরের মূল শক্তি হলো তাদের আদর্শভিত্তিক রাজনীতি। ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ভর করে তারা একটি নির্দিষ্ট ছাত্রগোষ্ঠীর সমর্থন টানতে সক্ষম হয়। ফলে তাদের ভোটব্যাংক স্থায়ী থাকে।

স্থানীয় ও গ্রামীণ ছাত্রদের সংযোগ
অনেক গ্রামীণ ও মাদ্রাসাপ্রসূত ছাত্র শিবিরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে। জাকসুতে এই ভোটব্যাংক শিবিরকে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে রাখে।

সংগঠনিক তৃণমূল ভিত্তি
অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের তুলনায় শিবির তৃণমূল পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সক্রিয় যোগাযোগ থাকে, যা ভোটে প্রভাব ফেলে।

তুলনামূলক চিত্র

ছাত্রদল: দুর্বল সংগঠন, ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতি, ইমেজ সংকট, আর্থিক ঘাটতি, নেতৃত্বহীনতা।

শিবির: শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন, আদর্শিক ভিত্তি, তৃণমূল সংযোগ, ধারাবাহিক সক্রিয়তা, সীমিত হলেও স্থায়ী ভোটব্যাংক।

বিশ্লেকদের মতে, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের ভরাডুবি কেবল তাদের সাংগঠনিক ব্যর্থতা নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির সংকটের প্রতিফলন। অন্যদিকে শিবির প্রভাবশালী না হলেও সংগঠিত থাকার কারণে কিছুটা এগিয়ে থাকতে পেরেছে। ভবিষ্যতে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে টিকে থাকতে চাইলে ছাত্রদলকে সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠন, ইতিবাচক ইমেজ গঠন এবং প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। অন্যথায় তারা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে, আর শিবিরের মতো সংগঠিত দলগুলো ধীরে ধীরে তাদের জায়গা দখল করে নেবে।

(প্রতি/রবি/এডি/রাহা)

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G