ভাইরালের দাসত্বে সাংবাদিকতা
বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম আজ এক অদ্ভুত সংকটে পড়েছে। একসময় এই গণমাধ্যম সমাজের বিবেক ছিল—অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াত, ক্ষমতার মুখোশ খুলে দিত, জনগণের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরত। এখন? এখন তারা মূলত ট্রেন্ড শিকারি—কে ভাইরাল, কে কার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল, কার বিয়েতে কতজন গিয়েছিল—এইসব মহান “সাংবাদিকতা”র মহোৎসবেই দিন কাটাচ্ছে।
এ যেন এক নতুন যুগ—“ভিউর যুগ”
এখন সাংবাদিকতার মান মাপা হয় স্ক্রিনে সংখ্যার গতি দেখে। কোনো প্রতিবেদন সত্য উদ্ঘাটন করল কি না, তা আর প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে—“কত ভিউ হয়েছে?”, “শেয়ার কতো?”, “কমেন্টে ঝড় উঠেছে তো?”
অর্থাৎ, এখন নিউজরুমে সম্পাদকরা আর সাংবাদিকদের মধ্যে নৈতিকতার আলোচনা হয় না, হয় অ্যালগরিদম বিশ্লেষণ।
নতুন ধর্ম: ভাইরালাইটিস!
এই নতুন মহামারির নাম – ভাইরালাইটিস।
যে একবার এতে আক্রান্ত হয়, তার বিবেক ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যায়। সে বুঝতে শেখে, সমাজের অন্যায় নিয়ে লেখা বা দুর্নীতির তথ্য খোঁজা তেমন লাভজনক নয়—তাতে ভিউ আসে না। কিন্তু কেউ যদি কাউকে ‘আনফলো’ করে, বা কারও বিয়ের খবর ‘লিক’ হয়—বাহ! সেদিন নিউজরুমে উৎসব।
সম্পাদক চেয়ারে হেলান দিয়ে বলবেন,
“চলো, আজ ট্রেন্ড বানাও—এইটা চলতেছে ভাই, মানুষ এইটা চায়!”
আর সাংবাদিকরা সারাদিন সেই তুচ্ছ কনটেন্টের শিরোনাম ঘষে, যেন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কে কাকে আনফলো করল তার ওপর।
কনট্রোভার্সি: নতুন জাতীয় খেলা
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান, সানবিন টনি, কিংবা রিপন মিয়ার মতো ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মিডিয়া এমনভাবে মাতামাতি করছে, যেন এগুলোই জাতীয় ইস্যু।
সানবিন টনি কাকে বিয়ে করলেন, আবু ত্বহা কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেন, রিপন মিয়ার মা লাইভে কী বললেন—সবই এখন প্রধান সংবাদ। যেন দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্নীতি—এসব নিয়ে আলোচনার সময় ফুরিয়ে গেছে।
এখন রিপোর্টাররা মাঠে যায় না তথ্য খুঁজতে; যায় ফেসবুক পেজ রিফ্রেশ করতে।
একসময় সাংবাদিকরা গোপন নথি সংগ্রহ করত, এখন করে স্ক্রিনশট।
একসময় সংবাদপত্রে ছিল প্রমাণভিত্তিক প্রতিবেদন; এখন খবর হয় “অনলাইন সূত্রে জানা গেছে, একটি পোস্টে নেটিজেনরা বলেছে…”
এই যে এইসব “কনট্রোভার্সি জার্নালিজম”—এটাই এখন আমাদের মিডিয়ার নতুন জাতীয় খেলা।
মাঠে খেলে না, ফেসবুকে খেলে।
যেখানে নিউজরুমে আলোচনা হয় – কে কার প্রেমে?
ভাবুন, এক সময় নিউজরুমে আলোচনা হতো—কোনো নতুন দুর্নীতির নথি কিভাবে প্রকাশ করা যায়, সরকারের কোন নীতি নিয়ে তদন্ত করা দরকার, কোথায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।
এখন সেখানে আলোচনা হয়—
“আজ আবু ত্বহা ভাই কাকে আনফলো করলেন?”
“সানবিন টনির বিয়েতে কারা ছিল?”
“রিপন মিয়ার মা কি আবার লাইভে আসবেন?”
আর এইসব খবর বানাতে বানাতে সম্পাদকরা এমন এক আত্মতৃপ্ত নিয়ে হাসি দেন, যেন সত্যিই তাঁরা সমাজ বদলে ফেলেছেন।
ফলে পাঠকেরাও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে—তুচ্ছতা এখন বিনোদন, আর বিনোদনই এখন খবর।
ভিউই রাজা, নীতি গায়েব–
মূলধারার সাংবাদিকতা আজ সোশাল মিডিয়ার পেছনে এমনভাবে ছুটছে, যেন লাইক-শেয়ারই নৈতিকতার নতুন সংজ্ঞা, আর ভাইরাল হওয়াই চূড়ান্ত সাফল্য।
তাদের যুক্তি সোজা—“দর্শক এটা চায়।”
হ্যাঁ, দর্শক হয়তো চায়, কিন্তু সাংবাদিকতা কি চাওয়ার ওপর চলে?
যদি তাই হতো, তাহলে তো হাসপাতালের বদলে সিনেমা হল বানানোই যথেষ্ট ছিল!
সত্য হলো—সাংবাদিকতা কখনো জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতা নয়; এটা দায়িত্বের ব্যাপার।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখন সেই দায়িত্ব হারিয়ে গেছে “ট্রেন্ডিং” তালিকায়।
সত্যের জায়গায় থাম্বনেইল-
আজ সাংবাদিকতার যে চেহারা, তা ইউটিউব থাম্বনেইলে সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায়।
“চমকে যাবেন আপনি!”,
“আপনি যা জানতেন না!”,
“শেষমেশ কী ঘটল দেখুন ভিডিওতে!”
এই শিরোনামগুলো দেখে বোঝা যায় না এটা নিউজ চ্যানেল, না নাটকের প্রচারণা।
সত্যের জায়গায় এসেছে থাম্বনেইল, অনুসন্ধানের জায়গায় এসেছে আবেগ, আর যুক্তির জায়গায় এসেছে নাটকীয়তা।
যে সাংবাদিকতা একদিন ছিল সমাজের বিবেক, আজ সেটাই কনটেন্ট মার্কেটিংয়ের কারখানা হয়ে গেছে।
প্রতিটি সংবাদ এখন একেকটা “ক্লিক-বেইট”, যেখানে সত্যি খবর থাকে না, থাকে দর্শকের কৌতূহল নিয়ে ব্যবসা।
গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু: ‘ভাইরাল’ না হলে অপ্রাসঙ্গিক
এখন দেশের বাস্তবিক ট্র্যাজেডিগুলো—দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, শিক্ষা সংকট, বেকারত্ব, রাজনৈতিক দমননীতি—সবই আড়ালে চলে যাচ্ছে। কারণ সেগুলো ভাইরাল হয় না।
বস্তিবাসীর জীবন, কৃষকের ক্ষতি, শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ—এসব এখন আর নিউজরুমে স্থান পায় না, কারণ দর্শক নাকি “এতে আগ্রহী নয়।”
এ যেন এক নতুন বাস্তবতা: যা ভাইরাল নয়, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এই মানসিকতা শুধু সাংবাদিকতাকেই নয়, গোটা সমাজকেই ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছে।
যেখানে অ্যালগরিদমই সম্পাদক-
আজকের সম্পাদকরা অনেকটা অ্যালগরিদমের কণ্ঠস্বরের মতো।
আগে সম্পাদকরা ঠিক করতেন কোন খবর ছাপা হবে, এখন তা ঠিক করে ফেসবুক ইনসাইটস।
যেখানে একসময় সম্পাদক মানে ছিল অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রতীক, এখন সে মানে হচ্ছে—“কে বেশি ভিউ এনে দিতে পারে।”
অর্থাৎ, সম্পাদক নয়—এখন অ্যালগরিদমই আসল সম্পাদক।
আর সাংবাদিকরা সেই অ্যালগরিদমের চাকর।
সাংবাদিকতার আত্মসমর্পণ-
এভাবে চলতে থাকলে সাংবাদিকতা একদিন পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।
কারণ একবার যখন সত্যের জায়গায় ট্রেন্ড বসে যায়, তখন আর বিবেক বাঁচে না।
মূলধারার গণমাধ্যম আজ আর জনতার কণ্ঠ নয়, বরং সোশাল মিডিয়ার প্রতিধ্বনি।
এখন তাদের প্রতিটি নিউজের আগে একটা নীরব প্রার্থনা চলে—
“হে ফেসবুক অ্যালগরিদম, আমাদের নিউজটা আজ একটিবার ভাইরাল করে দিও!”
এই প্রার্থনায় নেই সত্য, নেই দায়িত্ব, নেই বিবেক—আছে শুধু সংখ্যা।
এই সংখ্যা-নির্ভর সাংবাদিকতা আমাদের সমাজকে ধীরে ধীরে তুচ্ছতা আর সংবেদনশীলতার এক কৃত্রিম আস্তরণে ঢেকে ফেলছে।
অথচ সাংবাদিকতা মানে সত্য বলা, জনতার কণ্ঠস্বর হওয়া, ক্ষমতার মুখে আয়না ধরা।
কিন্তু আজ আমরা এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছি, যেখানে সাংবাদিকতার সংজ্ঞাই পাল্টে গেছে—
এখন “ক্লিক” মানেই সফলতা, “ভিউ” মানেই বিজয়।
তবু এখনও আশা আছে—
কারণ একদিন না একদিন, দর্শকও বুঝবে—তাদের চোখে যা ঝলমল করছে, সেটা আলো নয়, সেটা ভিউ কাউন্টের প্রতিফলন।
আর সেদিন, হয়তো সাংবাদিকতা আবার নিজের মর্যাদা ফিরে পাবে—
যেখানে সত্য হবে খবর, আর খবর হবে সত্যের প্রতিরূপ।
রাকিব হাসান
সম্পাদক, প্রতিক্ষণ














