ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জ্বলছে সুদান, নীল নদের তীরে আজ রক্ত ও ধ্বংসস্তূপ

সাহারার দক্ষিণ প্রান্তে, নীল নদের দু’কূল জুড়ে গড়ে ওঠা সুদান — এক সময় আফ্রিকার শস্যভাণ্ডার এবং তুলা, গম ও তৈলবীজের বৃহৎ উৎপাদক ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সামরিক বাহিনী (SAF) ও আধাসামরিক Rapid Support Forces (RSF)-এর মধ্যে সংঘর্ষ দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে; এতে গত দুই বছরের মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ নিহত ও লাখলাখ লোক বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে—এবং আধা দেশের মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটের মুখে।
সংঘাতের শুরু—ক্ষমতার লড়াই
২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সংঘাতের মূল কারণ হচ্ছে ক্ষমতার কুণ্ডলি: সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন জেনারেল আবদেল ফত্তাহ আল-বুরহান, আর আধাসামরিক বাহিনী RSF-এর নেতৃত্বে আছেন জেনারেল মোহাম্মদ হামদান (হেমেদতি) দাগালো। দু’পক্ষের মধ্যকার দখলদারিত্ব ও ক্ষমতা বজায় রাখার লড়াই দ্রুত শহর ও গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, শান্তিপূর্ণ নাগরিকদের উপর আক্রমণের ঘটনা বাড়ে।
মানবিক এপিক্যালিপ্স—ক্ষুধা ও গৃহহীনতা
সংঘাত ও ব্যবস্থাপনার ভাঙনে খাদ্য উৎপাদন থমকে গেছে; বিস্তীর্ণ কৃষিজমি অপারগ। জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো জানিয়েছে যে সহস্রাধিক পরিবার গৃহহীন এবং প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তা সংকটে — ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের মতে এখন প্রায় ২১ মিলিয়ন (প্রায় জনসংখ্যার ৪৫%) মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটের মুখে। অনেক অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের অবস্থা বা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিশ্চিত করা হয়েছে।
দারফুর—নৃশংসতা ও জাতিগত টার্গেটিং
দারফুর অঞ্চল বিশেষত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো RSF ও তার সহযোগী মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নৃশংসতা ও জাতিগত নির্মূলের অভিযোগ তুলেছে; বহু অনারব উপজাতিকে টার্গেট করে হত্যাকাণ্ড ও নির্বাসন ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে এই অঞ্চলে ব্যাপক হিংসা ও সম্ভাব্য জাতিগত নিরাময়ের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
আল-ফাশির (El Fasher) এবং শিশুদের ভয়াবহ বাস্তবতা
দারফুরের শহর আল-ফাশির ও আশপাশে নৃশংস আক্রমণের খবর বারবার আসছে। ইউনিসেফ ও অন্যান্য সংস্থার রিপোর্টে শিশু ও পরিবার শিবিরগুলোতে হামলা, হাসপাতাল লক্ষ্য করে বিমান-ঘাঁটনি বা ড্রোন হামলার ফলে প্রচুর হতাহতের তথ্য পাওয়া গেছে; ইউনিসেফ সন্দেহভাজন হামলায় শিশুসহ অসংখ্য প্রাণহানির কথা জানিয়েছে। কন্ট্রোল ও যোগাযোগ বিঘ্নিত এলাকাগুলোতে যথাযথ তথ্য যাচাই করা কঠিন হলেও স্থলভিত্তিক ও উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ থেকে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।
স্বর্ণ, বাহ্যিক সহযোগিতা ও সংঘাতের অর্থনীতি
সংঘাতে জড়িত অংশগুলোর অর্থনৈতিক উৎসগুলোও আলোচনায় এসেছে—বিশেষত দারফুরে স্বর্ণ সংক্রান্ত অভিযোগ। বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে যে স্বর্ণের অবৈধ পাচার এবং বহির্বিশ্বের কিছু অভিনেতার আর্থিক ও সামরিক সমর্থন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছে; এসব অভিযোগের মধ্যে আরব আমিরাতের সঙ্গে স্বর্ণচাঞ্চল্য সম্পর্কেও আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিশ্লেষণ উত্থাপন করেছে। এই আর্থিক লেনদেনগুলোর ফলে দখলদারিত্ব ও বিধ্বংসী লুটপাট আরও ত্বরান্বিত হয়েছে বলে নিরীক্ষকরা অভিমত দেন।
হাসপাতাল, স্কুল ও বেসামরিক অবকাঠামোর ধ্বংস
যুদ্ধে হাসপাতাল, স্কুল, বাজার ও পানিবিতরণ ব্যবস্থা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে; ফলে চিকিৎসা ও মৌলিক সেবার অভাব লক্ষণীয়। FAO, WFP ও UNICEF-এর যৌথ বিবৃতি অনুসারে এমন কিছু শহরে দুর্ভিক্ষের শর্তগুলো নিশ্চিত করা হয়েছে—তবে যুদ্ধে আক্রান্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হওয়ায় চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সীমিত কূটনৈতিক উদ্যোগ
জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও পশ্চিমা দেশগুলো ঘোর নিন্দা জানালেও কার্যকরী স্থায়ী সমাধান বা অসামরিক রক্ষার ব্যবস্থা চলে আসেনি। বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক চাপ ও সংকটস্থাপনে আলোচনার কথা থাকলেও মাঠে লড়াই থামেনি; ফলে মানবিক সংকট দিনে দিনে বাড়ছে। বিশ্ববাজারে সুদানের অবস্থা যথাযথ মনোযোগ পায় না বলেও বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।
মানবতার ডাক — কি করা যায়
সুদানের জনগণকে রেডি-মেড সাহায্যের অতিগুরুতর প্রয়োজন: বীজ, কৃষি সাপ্লাই, জরুরি খাদ্য সহায়তা, চিকিৎসা সরঞ্জাম, নিরাপদ আশ্রয় এবং বেসামরিক জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা দরকার। কিন্তু অর্থায়ন সংকট ও রাজনৈতিক জটিলতার কারণে সাহায্য কার্যক্রম সীমিত হচ্ছে — বিশেষত WFP-র ফান্ডশর্টফল ও দাতাদের অনিশ্চয়তার কারণে তাৎক্ষণিক সহায়তা ঝুঁকির সম্মুখীন।
সুদানের পতন কি আমাদের বিবেকের পরীক্ষা?
একদা আফ্রিকার সমৃদ্ধশালী কৃষিপ্রদেশ—সুদান—আজ যেন মৃত্যুর সন্নিকট। পাশ্চাত্য বা আঞ্চলিক শক্তির স্বার্থ, অস্ত্রচালান ও আর্থিক লোভ যখন ন্যায় ও মানবতার ওপর প্রাধান্য পায়, তখন অনাচারের দাম গুণতে হয় সাধারণ মানুষকে। ইতিহাস বলে দেবে আমরা কীভাবে আচরণ করলাম—নির্বিকার থেকে সক্রিয় সহায়তা পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ন্যায়বিচারের অংশ হবে।














