সংকটে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শিল্প

প্রকাশঃ জানুয়ারি ২৪, ২০১৫ সময়ঃ ৭:৩০ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৭:৩৫ অপরাহ্ণ

প্রতিক্ষন ডটকম:

images

নানামুখী সংকটে ক্ষতির মুখে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শিল্প । চলতি বছরে চাহিদার তুলনায় দেশে চিংড়ি উৎপাদন কম হওয়ায় এই সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

 
বর্তমানে যে কয়েকটি হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক কোম্পানি চালু আছে, বছরে তাদের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন। অথচ এর বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার মেট্রিক টন।চিংড়িসহ বিভিন্ন সংকটে ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক হিমায়িত প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো আছে নানামুখী সংকটে।

 
অপরদিকে চিংড়িতে নাইট্রোফোরান (অ্যান্টিবায়োটিক) ইস্যু ও মাননিয়ন্ত্রণের জন্য (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) দেওয়া সার্টিফিকেট টেম্পারিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে বর্তমানে জরিমানা করা সহ লাইসেন্সও স্থগিত করা হচ্ছে।চিংড়ি রপ্তানিকারকরা এ জন্য সরাসরি মৎস্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের নতুন অধ্যাদেশকে (অর্ডিন্যান্স) দায়ী করছেন। অবিলম্বে অর্ডিন্যান্সের সংশোধন এনে এ শিল্পকে রক্ষা করার দাবি তাদের।

 

 

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এস. হুমায়ুন কবীর জানান, সারা দেশে লাইসেন্সকৃত হিমায়িত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা আছে ৯০টি। যার মধ্যে ৪০টি খুলনায়। ৫০টির মধ্যে চালু আছে ৩৫টি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে চালু আছে ৫টি প্রতিষ্ঠান।

 

 

বাকি কারখানাগুলো চিংড়ির অভাব, ব্যবস্থাপনার সংকট ও অর্থনৈতিক কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এক সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি কারখানা ছিল। দিনে দিনে চিংড়ি চাষ কমে যাওয়া এবং আধুনিকতার ছোঁয়া না লাগায় উৎপাদনও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাড়ছে না। ফলে সম্ভাবনাময় এই শিল্প সংকটে পড়েছে।

 
বাংলাদেশে চিংড়ি উৎপাদন এত কম হওয়ার কারণ হিসেবে জনতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো আমাদের দেশের অনেক চাষি সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করছে। এছাড়াও ব্যাংকঋণ না পাওয়া এবং ঋণ পেলেও সময়মতো না পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী দেশে চিংড়ি ব্যহত চাষ হচ্ছে।

 

 

দেশে যে কয়েকটি চিংড়ি রপ্তানিকারক কোম্পানি চালু রয়েছে, তাদের বছরে গড় চাহিদা প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও এলাকাভিত্তিক অপপ্রচারে চিংড়ি চাষ হ্রাস পাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে এই শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের।

 

 

হুমায়ুন কবীর আরও বলেন, বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশ যে পরিমাণ চিংড়ি রপ্তানি করে তা ৩ শতাংশেরও কম। যার কারণে ক্রেতা ও ভোক্তাদের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ফলে চিংড়ির মূল্য নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না বাংলাদেশ। অথচ ভিয়েতনাম বিশ্ব বাজারে চাহিদার ১৭ শতাংশ চিংড়ি রপ্তানি করে ভোক্তাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারছে।

 

 

তিনি অভিযোগ করে বলেন, এখনো দেশে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান (ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটিস) আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা সম্বভব হয়নি। যদিও সম্প্রতি সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থার (ইউএনডিও, ইউএসএইড, ইউ কমিশন) সহযোগিতায় ল্যাব ফ্যাসিলিটিস উন্নত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

 

 

অপরদিকে চাহিদার তুলনায় চিংড়ি সরবরাহ কম থাকায় কারখানায় সরবরাহকারীরা অপদ্রব্য পুশসহ নানা অনৈতিক সুযোগও গ্রহণ করছে এসব কারণে অনেক সময় হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে সরকারের মৎস্য বিধি ১৯৯৭ (সংশোধনী ২০১৩) রক্ষা করতে পারছে না। অতীতে কোনো কোনো রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মান নিয়ন্ত্রণ সনদে টেম্পারিং করতেও বাধ্য হয়েছে।

 

 

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস অ্যাসোসিয়েশন ভিশন-২০২০ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে হিমায়িত মৎস্য রপ্তানির পরিমাণ ৬২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে।

 

খুলনা মৎস্য অধিদপ্তরের (মাননিয়ন্ত্রণ) উপ-পরিচালক মো. আবদুর রাশেদ দেশে বর্তমানে চিংড়ি চাষ কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করে প্রতিক্ষণকে বলেন, উৎপাদন আগের তুলনায় কম, কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় রপ্তানি আয় বেশি হচ্ছে। দেশে এখনো চিংড়ি চাষ উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি।তবে বর্তমানে কিছু কিছু স্থানে উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। এই পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টরে চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে ২ মেট্রিক টনের মতো।

 
তিনি জানান, বিশ্ব বাজারে চাহিদা অনুযায়ী নিরাপদ ও মানসম্মত পণ্য নিশ্চিত করতে না পারায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ক্রেতাদের (বায়ার) ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারছেন না। ফলে অন্যান্য দেশের রপ্তানিকারকের তুলনায় দাম তুলনামূলক কম পাচ্ছেন। উৎপাদন বৃদ্ধি ও পণ্যের মান বাড়াতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বিশ্ব বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।

 
সম্ভাবনায়ম এ শিল্পের সংকট ও ভাবমূর্তির জন্য কিছু অসৎ লোভী কারখানা মালিক, ডিপো মালিক ও মাছ সরবরাহকারীরা দায়ী। তারা চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে বিশ্ব বাজারে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন করছে। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে রপ্তানি বাণিজ্যে । গত বছর চিংড়িতে পুশের জন্য ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় ও ৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এছাড়া গত বছর বেশ কয়েকটি হিমায়িত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানাকে ১৯ লাখ টাকা জরিমানা ও ৪টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করা হয়।

 
উপ-পরিচালক বলেন, গত দুই বছর চিংড়িতে নাইট্রোফোরানের (অ্যান্টিবায়োটিক) অভিযোগ নেই বললে চলে। কারণ মৎস্য অধিদপ্তরের তদারকি, চাষিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করে গড়ে তোলায় কিছুটা ফল পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে খুলনাসহ সারা দেশে ২ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদা ও ৬৬ হাজার হেক্টরে গলদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে।

 

 

উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন চিংড়ি ঘেরের পানির গভীরতা বাড়ানো, ভাইরাসমুক্ত পোনা ঘেরে অবমুক্ত করা, পানিতে ঠিকমতো চুন দেওয়া, হ্যাচারি পোনা পরিচর্যা করে ঘেরে অবমুক্ত করা এবং পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব হবে।

প্রতিক্ষন/এডি/মাসুদ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

December 2025
SSMTWTF
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031 
20G