মানবতাবাদী সাধক ও ধর্মপ্রচারক ছিলেন হযরত খাজা নাছের (রহঃ)

প্রকাশঃ মে ১১, ২০২২ সময়ঃ ৯:৪২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১০:১১ পূর্বাহ্ণ

খাজা মাছুম বিল্লাহ কাওছারী

খাঁন বাহাদুর খাজা আহসানউল্লার বংশধর ও যোগ্য উত্তরসূরি হযরত শাহ সুফী খাজা নাছের রহঃ (১৮৮৫-১৯৮২) ছিলেন একজন প্রোথিতযশা মানবতাবাদী সাধক ও ধর্মপ্রচারক। কোরআন, হাদিস, ইসলামী আইন-কানুন, সমাজনীতি ও সাহিত্যে তার ছিল এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি ছিলেন সুমধুর কণ্ঠস্বরের অধিকারী একজন উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের ঐশর্যমন্ডিত প্রভাত পুরুষ। বাংলা সহ উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের প্রায় সব অঙ্গনেই ছিল এই মহৎ মানুষটির নীরব পদচারণা। তিনি কখনো সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে বা ধর্মীয় গোড়ামীতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন সকল মানুষই জগৎ স্বামীর অপরূপ লীলায় সৃষ্টি, তাই স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে প্রানউজার করে। সাম্য ও প্রেমের ধ্যান-ধারণা নিয়ে ভালোবাসতে হবে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দ্যেশে।
দক্ষিণ বঙ্গে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী সংস্কতি বিকাশে যারা অগ্রগণ্য, তাদের বাতিঘর হিসেবেও সুপরিচিত হযরত শাহ সুফী খাজা নাছের রহঃ। খাজা নাছের রহঃ এর পূর্বপুরুষরা ধর্মীয় বিবেচনায় ছিল খুব উঁচু তফকার মানুষ। খাজাদের পূর্বপুরুষরা কাশ্মীরে স্বর্ণরেণু এবং চামড়ার ব্যবসায়ী ছিলেন বলে জানা যায়। ঢাকা নবাবী জমিদারীর প্রথম প্রতিষ্ঠাতা হলেন মৌলভী খাজা হাফিজুল্লাহ কাশ্মীরি, তিনি পারিবারিক ঐতিহ্যকে বহন কারী, ধর্মীয় আঘাত পান্ডিত্বের অধিকারী। ১৭৯৫ সালে আহসানুল্লাহ (হাফিজুল্লাহর ভাই এবং আলীমুল্লাহ’র পিতা)-এর মৃত্যুর পরে হাফিজুল্লাহ আলীমুল্লাহকে লালন পালন করেন এবং তাকে জমিদারী পরিচালক হিসেবে তৈরী করেন।
খাজা আহসানুল্লাহ (১৮৪৬-১৯০১) একাধারে গীতিকার, নাট্যকার ও কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। তিনি বেশ কিছু ঠুমরী ঢংয়ের গীত রচনা করেন। তার রচিত উর্দু নাটকগুলো নওয়াববাড়িতে মঞ্চস্থ হতো। তিনি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। তিনি “শাহীন” (যার অর্থ রাজপাখী) এই কাব্যনাম ধারণ করেছিলেন। কুল্লিয়াতে শাহীন নামে তার উর্দু-ফার্সি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তার নির্দেশনায় ঢাকা থেকে ১৮৮৪ সালের আহসানুল কাসাস নামে উর্দু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তিনি নিয়মিত রোজনামচা লিখতেন। তার লেখা তারিখে খান্দানে কাশ্মীরিয়াহ (কাশ্মীরি বংশের ইতিহাস) নামক (অপ্রকাশিত) একটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
হযরত শাহ সুফী খাজা নাছের রহঃ এর পূর্বসূরীরা অধ্যাতিকতা চর্চায় থাকতো সদা নিমগ্ন। পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি আপন পিতা হযরত শাহ সুফী ফয়জুদ্দীন রহঃ এর নির্দেশে গাউছুল আযম বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ এর বংশধর হযরত বোগদাদ শাহ রহঃ এর কাছে মুরীদ হন এবং এলমে শরীয়াত ও এলমে মারেফাতের জ্ঞান অর্জন করার লক্ষ্যে তালিম ও তালকিন নিতে থাকেন। বুজুর্গ পিতা অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুত্রের খোদা ভীরুতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, আধ্যাত্মিকতা ও তাছাওফ চর্চায় খুশি হয়ে তার পারিবারিক সকল দায় দায়িত্ব পুত্রের কাঁধে তুলে দেন।
হযরত শাহ সুফী খাজা নাছের রহঃ সদা-সর্বদা মনে করতেন- আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে পার্থিব সকল বন্ধন অতিক্রম করিয়া ধ্রুব সত্যের দিকে চলিতে চেষ্টা করা। ‘আধ্যাত্মিকতায় যা দান করে তা হলো আমাদের ঔদাসীন্যতা,মনগড়া আচারাদি, দুনিয়াবী মোহ বা লোভ-লালসা, অসাড়তা ঘুচিয়ে দিয়ে জগৎ স্রষ্টা আল্লাহ মুখী হওয়া। অর্থাৎ তখনই আমরা চেতনার দ্বারা চেতনাকে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে পাই। সেই রকম করে যখন পাই তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সমস্তই জগৎ স্বামীর অপুরূপ লীলা।
তিনি আরো মনে করতেন-আধ্যাত্মিকতা বলতে সেই বাস্তবতাকে বোঝানো হয়, যা আমাদের প্রতিদিনের স্থূলতা থেকে অনেক দূরের কিছু। এটি হচ্ছে সেই গহিন পথ যার দ্বারা একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকা কিংবা তার অস্তিত্ব আবিষ্কারের প্রচেষ্টা স্পষ্ট হয়। ধ্যান, প্রার্থনা, প্রত্যাশা দিয়ে একজনের অন্তরজীবনের উন্নতি হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার বাস্তবতা হতে পারে জগৎ স্বামীর সঙ্গে নিবীড় যোগাযোগ এবং এই সংযোগ ব্যক্তি থেকে প্রসারিত হতে হতে মানব সমাজ, প্রকৃতি, বিশ্বলোক ও আল্লাহর আরশ পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়। জীবনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাও হতে পারে পরমার্থসাধনা। যে বিশ্বাস ধারণ করে আল্লাহ সম্পর্কে অন্তর্নিহিত ভাবনা কিংবা বিশ্বের সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের জন্য কাতরতাই আধ্যাত্মিকতা?

আধ্যাত্মিকতা চর্চায় কাসিদার গুরুত্ব অপরিসীম বলে শাহসুফী খাজা নাছের রহঃ অধিকাংশ সময়ই বরণ্য ওলি- আওলিয়াদের রচিত কাছীদা পাঠ করতেন মধুর সুরে। ইতিহাস ঘাটা ঘাটি করলে দেখাযায় মুঘল আমল (১৫৫৬) থেকেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে কাসিদার প্রচলন শুরু হয়। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রূপদী যুগ শুরু হয়। কাসিদা গেয়ে গেয়ে সেহরীর সময় রোজাদারদেরকে সেহেরি খাওয়ার জন্য ওঠানোর প্রচলন ছিলো। খান বাহাদুর খাজা আহসানউল্লাহর সময় কাসিদার উৎকর্ষতা ব্যাপক ভাবে লাভ করে। পূর্ব পুরুষের এই পারিবারিক ধারা বাহিকতা শাহ সুফী ফয়জুদ্দীন রহঃ যেমন নিজে পালন করতেন তেমনি ভাবে নিজের সন্তানদের কেও পালন করার কঠোর তাগিদ দিতেন। বৃটিশ শাসন আমলে কিংবা তার পরে পাকিস্তান আমলে গান, কবিতা বেশির ভাগই ছিলো উর্দু বা ফার্সিতে। হযরত শাহ সুফী খাজা নাছের রহঃ কাজের অবসরে বিভিন্ন সময় মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহঃ) ও শেখ সাদী (রহঃ) সহ বিভিন্ন জগৎ বিখ্যাত কবি বা আধ্যাতিক সাধকগণের উর্দু ও ফার্সি কাসিদা বা শের সুমধুর সুরে আত্মশুদ্ধির নিয়তে পাঠ করতো। কাছীদায়ে বুরদা-তুলিল-বছিরি সুমধুর সুরে পাঠ করতেন আর দুনয়নের জলে বুক ভাসাতেন নবী প্রেমের ব্যাকুলতা অনুভব করে। কছাছুল আম্বিয়া ও তাজকেরাতুল আউলিয়া ছিল তার খুব প্রিয় পুস্তিকা, যার মাধ্যমে তিনি আল্লাহ প্রদত্ব নবী রাছুল ও জগৎ বিখ্যাত ওলি-আউলিয়া, পীর বুজুর্গগনের ব্যাপারে গভীর জ্ঞান রাখতেন। তার উল্ল্যেখ যোগ্য কাসীদাগুলোর মধ্যে একটি এখানে দেয়া হলো –

از جمادی مُردم و نامی شدم
وز نما مُردم به حیوان برزدم
مُردم از حیوانی و آدم شدم
پس چه ترسم کی ز مردن کم شدم؟
حملهٔ دیگر بمیرم از بشر
تا برآرم از ملائک بال و پر
وز ملک هم بایدم جستن ز جو
کل شیء هالک الا وجهه
بار دیگر از ملک پران شوم
آنچ اندر وهم ناید آن شوم
پس عدم گردم عدم چون ارغنون
گویدم که انا الیه راجعون

در راه طلب عاقل و دیوانه یکی است
در شیوهی عشق خویش و بیگانه یکی است
آن را که شراب وصل جانان دادند
در مذهب او کعبه و بتخانه یکی است
প্রচলিত ধারণায় আধ্যাত্মিকতা বা পরমার্থসাধনাকে ধর্মীয় জীবনেরই অংশ বলা হয়। অবশ্য ইউরোপ-আমেরিকায় এ শব্দটি দ্বারা বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম চর্চার বাইরের অনেক কিছুকে বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন, ‘ধ্যান/মোরাকাবা (Meditation) অধ্যাত্মসাধনার অংশ হলেও এর দ্বারা শরীরের ব্যাপক সুস্থতার ধারণা যুক্ত হয়েছে যা পাবলিক হেলথ বা গ্লোবাল হেলথ এ চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। খোদা বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী যেকোনো ব্যক্তি ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন এ কথা প্রাচীন কাল থেকেই ওলি-আউলিয়া, সুফী-দরবেশগণ চর্চার মাধ্যমে প্রমান করেছেন!!!!!

খাজা মাছুম বিল্লাহ কাওছারী

লেখক ও সম্পাদক
দৈনিক কালের কথা

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G