আমি কোনো নম্বর হতে চাই না

প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২৬, ২০১৫ সময়ঃ ১:৩৭ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:৩৭ অপরাহ্ণ

ডেস্ক রিপোর্ট, প্রতিক্ষণ ডটকম:

3784_1রাতে দীর্ঘ সময় ধরে বোমাবর্ষণ করেছে ইসরাইলি জঙ্গিবিমান।মঙ্গলবারের ভোরে খোলা জানালা দিয়ে ঘরে ঢোকা

লোকজনের কথাবার্তার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। রাস্তার ওপারে আনরাওয়া পরিচালিত স্কুলে নতুন গৃহহীন লোকজন এসে আশ্রয়ের জন্য ভিড় করেছে। গাজার যে এখন কী অবস্থা!

এ শহর এখন মৃত্যুপুরী। আকাশ থেকে বোমা, সাগরের যুদ্ধজাহাজের কামান আর স্থলভাগে ট্যাংকের গোলাবর্ষণের ফলে যাকে বলে একেবারে নরক গুলজার।

কে কখন কোথায় মারা যাবে তা কেউ জানে না। ট্যাংক ও যুদ্ধজাহাজের কামানের গোলায় মৃত্যু এড়াতে উপকূলবর্তী বেইত লাহিয়া ও বেইত হানুম থেকে গত দু’সপ্তাহে হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বাঁচার ইচ্ছা ছাড়া তারা সাথে তেমন কিছু আনতে পারেনি, তারপর এসে পৌঁছেছে জাবালিয়ায়।

আমি এ জাবালিয়ারই বাসিন্দা। গোটা জাবালিয়াই এক আশ্রয় শিবির। ১৯৪৮-এর নাকবার পর, যখন গোটা ফিলিস্তিনের নানা গ্রাম ও শহর থেকে অস্ত্রেরমুখে ফিলিস্তিনি বিতাড়ন শুরু হয়, তখনি জাবালিয়ার আশ্রয় শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি গাজা ভূখণ্ডের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ আশ্রয় শিবির। ৬৬ বছর পর শিবিরটিতে নতুন করে ছিন্নমূল মানুষের ঢল নেমেছে।

আমার ঘরের জানালা দিয়ে আনরাওয়ার স্কুলটি দেখা যায়। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধা, চিন্তা ও বিষাদে ম্রিয়মাণ মায়েদের চোখে পড়ছিল। স্কুলের খেলার মাঠে বসে আছে তারা। মায়েদের কোলে রয়েছে শিশুরা, অনেকেই কাঁদছে। বয়স্ক লোকেরা উদ্বিগ্ন চোখে আকাশের দিকে বারবার তাকিয়ে দেখছে। সেখানে চক্কর দিচ্ছে ড্রোনগুলো। ভীষণ গোলমেলে অবস্থা। এর মধ্যেই আনরাওয়ার লোকেরা সব কিছু গোছানোর চেষ্টা করছে।

পরশু একুশে জুলাই রাতটা ছিল গাজার ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর রাত বিশেষ করে বেইত হানুমের পূর্ব এলাকার অধিবাসীদের জন্য। সীমান্ত থেকে ট্যাংকগুলো আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। পথে যা পড়ে তার সবই গুঁড়িয়ে দিয়ে অগ্রসর হয় যন্ত্রদানবগুলো। প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি স্কুল, প্রতিটি ফলের বাগান ধ্বংস হয়। গাজার কেউ জানে না কোথায় এসে পরবর্তী গোলা বা রকেট তার মাথায় আঘাত হানবে। কেউ জানে না কখন সে মারা গিয়ে খবরের কত নম্বর লাশে পরিণত হবে। কেউ যদি চিন্তা করে সে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে, যেভাবে উবে যায় এক ফোঁটা পানি, তার চিহ্নমাত্রও থাকবে না এ চিন্তা তাকে পাগল করে দেবে।

তিন দিন আগে ইহুদিদের এক রকেটের আঘাতে চার ছেলেমেয়ে ও তাদের মা-বাবাসহ একই পরিবারের ছয়জন মারা যায়। নিহত দু’ভাই ও দু’বোন ছিল প্রতিবেশী আয়াদের চাচাতো ভাইবোন। সারা দিন রোজা শেষে সন্ধ্যায় ইফতারি সামনে নিয়ে বসেছিল তারা। রকেটের আঘাতে চার ভাইবোন তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারায়। আয়াদ আমাকে জানায়, নয় বছরের ছোট বোনের শরীরের কিছুই পাওয়া যায়নি। হাত-পা বা শরীরের কোনো অংশই। যেন সে কোনো দিন এ পৃথিবীতে ছিল না। অথচ কিছুক্ষণ আগেও সে ছিল। মনে হয়, রকেট সরাসরি তার দেহে আঘাত হেনেছিল।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে স্কুলের ক্লাসরুম ও সামনের মাঠে টানানো তাঁবুতে নবাগত ছিন্নমূলদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আনরাওয়ার এক লোক মেগাফোন হাতে সবার উদ্দেশে বলে, সবাইকে তার নির্দেশ মেনে চলা দরকার। আমি আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে গেলে আনরাওয়া কর্মকর্তাটির কথা আমার মাথায় প্রতিধ্বনি তোলে। যুদ্ধ বা সঙ্ঘাতের সময় সাধারণ নিয়ম হলো সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে নিতে হবে। কারণ রাতের পর রাত আপনি এক পলকও ঘুমাতে পারবেন না। সুতরাং যতটা পারেন ঘুমিয়ে নেবেন। কারণ ঘুম জমিয়ে রাখতে হবে আরবিতে যেমনটি বলা হয় চোখের পেছনে।

একটি মেয়েশিশু সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে। তার শরীরের কোনো অংশ হাড়-হাত-পা কিছুই পাওয়া যায়নি। এমন কিছুই মেলেনি যা থেকে বলা যায় যে, কয়েক সেকেন্ড আগেও মেয়েটি এখানে ছিল।

আমার মাথা, আমার স্মৃতিরা পুরনো সঙ্গীত, পুরনো ইচ্ছা আর আশাগুলোর সাথে তালগোল পাকিয়ে গেলেও তৈরি হয় এক ছবি। স্মৃতি কী ও আশা কী তার মধ্যে আমি সব সময় পার্থক্য করতে পারি না।

আমার ছেলে ইয়াসের কোনো শব্দ না করে ঘরের মধ্যে হাঁটছিল। আমি দেখতে পাচ্ছি, আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে পা ফেলছে সে। আমাকে জাগাতে চায় না। মৃদু হেসে আমি তার চলাফেরা লক্ষ করতে থাকি। সে তার আইপ্যাড ও চার্জার নেয়। লক্ষ করলাম, পনেরো ঘণ্টা পর বিদ্যুত ফিরে এসেছে। আমার বাচ্চারা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে। যখনই বিদ্যুৎ ফিরে আসে, তারা তড়িঘড়ি করে তাদের আইপ্যাডগুলো চার্জ দিয়ে নেয় যাতে বিদ্যুৎ না থাকলেও সেগুলোতে খেলা করতে পারে। দিনের বেলা কিভাবে সময় কাটাবে সে ব্যাপারে তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে।
চোখ খোলার পর আমার প্রথম প্রশ্ন হলো অস্ত্রবিরতি কখন হবে? প্রত্যেকেরই এই এক প্রশ্ন। ষোলো দিন আগে আট জুলাই ইসরাইল গাজায় বিমান হামলা শুরু করেছিল। এখন তার সাথে স্থল হামলা শুরু করায় পরিস্থিতি দুঃস্বপ্নের রূপ নিয়েছে। অনেক সময় আমি চোখ বন্ধ করেছি ও ভেবেছি কেমন হতো যদি দেখা যেত যে, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম এবং যা দেখেছি তার সবই স্বপ্ন! আমি মাথা ঝাঁকুনি দেই ও চার দিকে তাকাই। সব কিছুই বাস্তব, স্কুলের আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে, সূর্য আলো ছড়াচ্ছে, পাশের বাড়ির মহিলা মহল্লার অন্য নারীদের সাথে তার বাড়ির সামনে বসে আছে। সব কিছুই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। এটা যে স্বপ্ন, এটা যে দুঃস্বপ্ন, তার কোনো আভাস নেই।
একুশে জুলাই বেইত হানুম ও শাজিয়ায় শতাধিক লোক মারা গেছে। আমি আমার বন্ধু ফারাজ, আবু আসীল ও ওয়াফার সাথে ফারাজের বাড়িতে বসে প্রতি রাতের মতো হুঁকা সেবন করছিলাম। ফারাজ কোথাও খবর শোনা যায় কি না, সেজন্য রেডিওর ডায়াল ঘোরাচ্ছিল। সে হয়তো এমন কিছু শুনতে চাইছিল, যা তার মনকে শান্ত করবে। রেডিওর কণ্ঠটি জানান, গত দু’সপ্তাহের হামলায় মোট নিহতের সংখ্যা ৫৬৭ জনে দাঁড়িয়েছে। তিনি এরপর নিহতরা কোথায় মারা গেল, তাদের বয়স, নারী-পুরুষের সংখ্যা, হামলার পদ্ধতি ইত্যাদি বিবরণ পাঠ করে চলেন। তিনি আরো জানান, কয়েক ঘণ্টা আগে একটি গোলার আঘাতে তিনটি শিশু মারা গেছে। তাদের সবার মাথা উড়ে গেছে। সে অবস্থায়ই তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়। রেডিওর কণ্ঠটি পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে চলেন। আহত লোকের সংখ্যা তিন হাজার ৭০০ পৌঁছেছে। ৬৭৩টি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি বাড়ি।
সব কিছুই এখন নম্বরে পরিণত হয়েছে। গল্পগুলো এ সব নম্বরের পেছনে লুকিয়ে আছে, ছদ্মবেশে আছে বা হারিয়ে গেছে। মানুষের জীবন, আত্মা,দেহ সব কিছুই নম্বরে রূপান্তরিত হয়েছে। টিভির নিচে স্ক্রিনে যখন ব্রেকিং নিউজ দেখানো হয়, আপনি তাতে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না, যা পারবেন তা হলো শুধু এটা লক্ষ করতে যে, প্রতি মিনিটে সংখ্যাগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে। আপনি আরেকবার শ্বাস নেয়ার আগেই দেখবেন যে নিহতদের সংখ্যা পরিবর্তিত হয়েছে। হামলার প্রথম দু’ঘণ্টায় টিভির লোকেরা নিহতের নাম প্রদর্শন করে তা পর্দায় রেখে দিয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের নাম মুছে গেছে, শুধু সংখ্যা দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ নিহতেরা এখন সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। এ সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে শুধু বাড়তেই থাকে আর খবর পাঠ চলতে থাকে।
ভাবুন, ভাবুন তো একটি মানুষ যখন একটি নম্বরে পরিণত হয়, তখন অবস্থাটা কী দাঁড়ায়। আপনি আর আতেফ আবু সাইফ নন আপনি হচ্ছেন নিহত নম্বর ৫৬৮। আপনি অনেক বড় সংখ্যার সামান্য একটি ডিজিট মাত্র, আর এ নম্বর বেড়েই চলেছে। আপনার গোটা জীবনটাই পর্যবসিত হয়েছে একটি নম্বরে। অন্য সব নম্বরের ভিড়ে প্রত্যেকটি নম্বর তাদের গুরুত্ব হারিয়েছে। কারণ যা গুরুত্বপূর্র্ণ তা হলো বড় নম্বর। প্রতিবার এ অঙ্ক বাড়ে, অলিখিত বিস্ময় জড়িয়ে থাকে বড় হতে থাকা সংখ্যার সাথে এর সাথে মিশে থাকা অশ্রুত চিৎকার ধ্বনিত হতে থাকে উচ্চরোলে। সাংবাদিকেরা বিপর্যয় ভালোবাসে, তারা নম্বর, পরিসংখ্যান, ডাটা পছন্দ করে। তারা ক্যামেরার সামনে চোখের পানি ও আবেগ পছন্দ করে। ধ্বংস হচ্ছে ক্যামেরার অতি উপাদেয় খাদ্য। তাদের ক্যামেরা রমজানের রোজা রাখে না, শুধু খায় আর খায়।
একজন মানুষ যখন নম্বরে পরিণত হয়, তখন পুরুষ বা নারী যেই হোক তার সব গল্প হারিয়ে যায়। প্রতিটি নম্বরই একটি গল্প, প্রতিটি শহীদই একটি কাহিনী, একটি হারিয়ে যাওয়া জীবন। অথবা জীবনের এ অংশটি হারিয়ে গেলেও বাকি অংশ অন্য গল্প বলে। পরের গল্প। একজন বাবা বা মা যখন মারা যায়, তারা শিশুসন্তান রেখে যায়, যারা কোনো হিরো নয় নিছক মানুষ। দুঃখ ও সন্তাপ নিয়ে তারা সেই অসহায় শিশু যারা তাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয় নিবিড়তম স্নেহ ও ভালোবাসা হারিয়েছে।

একটি গল্প আছে যা হারিয়ে গেছে, আরেকটি গল্প আছে যা অনুসরণযোগ্য। সমুদ্রসৈকতে খেলতে থাকা যে চারটি শিশুকে হেলিকপ্টার গানশিপ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছে, তারা চারটি নম্বর নয় তারা চারটি গল্প, চারটি জীবন। খান ইউনিসে সারা দিন রোজার শেষে ছোট বাড়িটির ছাদে কাওয়ারি পরিবারের ছয় সদস্য ইফতারি সামনে নিয়ে বসে থাকার সময় ড্রোন তাদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলো, তারা ছয়জন মাত্র নয়। ড্রোন থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র তাদের ছয়টি অপরিসীম মূল্যবান জীবন, ছয়টি অজানা গল্পের ইতি টেনে দিয়েছে।

ছয়টি উপন্যাস যা মাহফুজ, ডিকেন্স বা মারকেজ সন্তোষজনকভাবে লিখতে পারতেন না। এসব উপন্যাসের কাঠামো ও প্রয়োজনীয় কবিতা খুঁজে পাওয়ার জন্য দরকার হতো একটি জাদু, একটি প্রতিভা। পরিবর্তে তারা হয়ে গেছে গল্প আর খবরে ঠাঁই পাওয়া নম্বর। কামনা-বাসনা, বেদনার আর্তি, সুখের দিনগুলো, স্বপ্ন দেখার মুহূর্ত শেষ হয়ে গেছে।
আমি কোনো নম্বর হতে, খবরের একটি টুকরো হতে, গাজা থেকে আসা খবর পাঠ শেষ করার জন্য অধৈর্য হয়ে অপেক্ষমাণ সুন্দরী সংবাদ পাঠিকার ঠোঁটে উচ্চারিত নাম হতে চাই না। আমি বিরাট কিছুর মধ্যে ক্ষুদ্র নম্বর, ডাটার অংশ হতে চাই না। আমি হাজারো ছবির মধ্যে একটি ছবি হতে চাই না, যা মানবাধিকার কর্মী বা সহানুভূতিশীলরা টুইটারে শেয়ার বা ফেসবুকে পোস্ট করার পর লাইকস ও কমেন্টসের বন্যা বয়ে যায়।
আমার আরেক প্রতিবেশী আহমাদ যখন আল নাদা সীমান্ত এলাকায় তার পরিবারকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেল, সেও নম্বর হতে চায়নি। নিহত বা আহত কেউই চায়নি। এ সব নম্বরের পেছনে যে গল্পগুলো রয়েছে তা কোনো দিন কেউ জানতেও চাইবে না। তারা যে সুন্দর জীবন কাটাত, সে সৌন্দর্য কেউ উন্মোচিত করবে না। প্রতিটি হামলার সাথে সাথে মৃতদের নম্বরের মোটা, কুৎসিত পর্দার আড়ালে সে অনুপম সৌন্দর্য চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে ।

 

তথ্য সূত্র: আতেফ আবু সাইফ

 

প্রতিক্ষণ/এডি/আকিদুল ইসলাম

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G