নারীর মূল্যঃশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২২, ২০১৫ সময়ঃ ৬:৩২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৬:৩২ অপরাহ্ণ

সাহিত্য ডেস্ক,প্রতিক্ষণ ডট কম

শরতমণি-মাণিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসাবে নারীর মূল্য বেশী নয়, কারণ, সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটা নিত্য-প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই। কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধ করি একফোঁটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করেন না। তেমনি—ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইঁহার যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে—আজ নহে। আজ ইনি সুলভ।

কিন্তু দাম যাচাই করিবারও একটা পথ পাওয়া গেল। অর্থাৎ পুরুষের কাছে নারী কখন, কি অবস্থায়, কোন্‌ সম্পর্কে কতখানি প্রয়োজনীয়, তাহা স্থির করিতে পারিলে নগদ আদায় হউক আর না হউক, অন্ততঃ কাগজে-কলমে হিসাব-নিকাশ করিয়া ভবিষ্যতে একটা নালিশ-মকদ্দমারও দুরাশা পোষণ করিতে পারা যায়। একটা উদাহরণ দিয়া বলি। সাধারণতঃ, বাটীর মধ্যে বিধবা ভগিনীর অপেক্ষা স্ত্রীর প্রয়োজন অধিক বলিয়া স্ত্রীটি বেশি দামী। আবার এই বিধবা ভগিনীর দাম কতকটা চড়িয়া যায় স্ত্রী যখন আসন্ন-প্রসবা; যখন রাঁধা-বাড়ার
লোকাভাব, যখন কচি ছেলেটাকে কাক দেখাইয়া বক দেখাইয়া দুইটা খাওয়ান চাই। তাহা হইলে পাওয়া যাইতেছে—নারী ভগিনী-সম্পর্কে বিধবা অবস্থায়, নারী ভার্যা-সম্পর্কীয়ার অপেক্ষা অল্প মূল্যের। ইহা সরল স্পষ্ট কথা। ইহার বিরুদ্ধে তর্ক চলে না! একটা শ্লেট-পেন্সিল লইয়া বসিলে নারীর বিশেষ অবস্থার বিশেষ মূল্য বোধ করি আঁক কষিয়া কড়া-ক্রান্তি পর্যন্ত বাহির করা যায়। কিন্তু কথা যদি উঠে, ইহার অবস্থা-বিশেষের মূল্য না হয়, একরকম বোঝা গেল, কিন্তু নারীত্বের সাধারণ মূল্য ধার্য করিবে কি করিয়া, যখন ইঁহার জন্য সোনার লঙ্কা নিপাত হইয়াছিল, ট্রয়-রাজ্য ধ্বংস হইয়া গিয়াছিল; আরও ছোট-বড় কত রাজ্য হয়ত ইতিপূর্বে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, ইতিহাস সে কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে নাই। এখানে এতবড় প্রয়োজন নারীতে কি ছিল যে সাম্রাজ্য ভাসাইয়া দিতেও মানুষ পরাঙ্মুখ হয় নাই, প্রাণ দিতেও দ্বিধা করে নাই। তোমার শ্লেটখানিতে জায়গা কত যে ইহার দাম তুমি কষিয়া বাহির করিয়া দিবে? কথাটা বাহিরের দিক হইতে অস্বীকার করি না, কিন্তু ভিতরের দিকে চাহিয়া আমি যদি প্রশ্ন করি, মানুষ রাজ্যের দিকে চাহিয়া দেখে নাই সত্য, কিন্তু তাহা কতটা যে নারীর দিকে চাহিয়া, আর কতটা যে নিজের অসংযত উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তির দিকে চাহিয়া—সে জবাব আমাকে কে দিবে?

নারীত্বের মূল্য কি? অর্থাৎ, কি পরিমাণে তিনি সেবাপরায়ণা, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে কষ্টে মৌনা। অর্থাৎ, তাঁহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী! অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন। দাম কষিবার এ ছাড়া যে আর কোন পথ নাই, সে কথা আমি পৃথিবীর ইতিহাস খুলিয়া প্রমাণ করিয়া দিতে পারি ইয়োরোপ এ-দেশীয়কে চোখ রাঙ্গাইয়া বলে, “তোমরা নারীর মূল্য জানো না, মর্যাদা বোঝ না, আমোদ-আহ্লাদে তাহাকে যোগ দিতে দাও না, ঘরের কোণে আবদ্ধ করিয়া রাখো—তোমরা বর্বর।” মনু প্রভৃতি হইতে ‘পূজার্হা’ ইত্যাদি শ্লোক তুলিয়া পাল্টা জবাব দিয়া আমরা বলি, “না, আমরা মা-বোনের মুখে রঙ মাখাইয়া শ্যাম্পেন-ক্লারেট পান করাইয়া উত্তেজিত করিয়া সভা-সমিতিতে নাচাইয়া লইয়া ফিরি না, আমরা ঘরের কোণে পূজা করি। তোমাদের ঐ বলডান্সের পোশাক দেখিয়া লজ্জায় অধোবদন হই, নাচ দেখিয়া চোখ বুজি। আমরা বরং বর্বর হইয়া চিরদিন মা-বোনকে ঘরের কোণে বদ্ধ করিয়া রাখিব, কিন্তু তাঁহাদের মর্যাদা বাড়াইবার জন্য প্রকাশ্যে ভিড়ের মধ্যে নাচাইতে পারিব না।” সাহেবেরা অবশ্য এ তিরস্কার গ্রাহ্য করে না। প্রসিদ্ধ আচার্য Prof. Maspero সাহেব প্রাচীন মিশরে নারীর সভ্যতা-প্রসঙ্গে তাঁহার Dawn of Civilisation গ্রন্থে এক স্থানে লিখিয়াছেন, মিশরীয় মহিলারা বক্ষ প্রায় অনাবৃত করিয়া রাজপথে বাহির হইতেন—সুতরাং, নিশ্চয়ই তাঁহারা যথেষ্ট উন্নত হইয়াছিলেন। যেহেতু “like Europeans they must have coveted public admiration.” ফন্দিটা অব্যর্থ, তাহা অস্বীকার করা চলে না। নিজেদের মহিলা সম্বন্ধে তিনি অসঙ্কোচে এ কথা বলিয়া গেলেন, কিন্তু এই admiration কথাটার ঠিক বাংলা তর্জমা করিতেও আমাদের লজ্জায় মাথা কাটা যায়। যাহা হউক, আমাদের উত্তরটাও নেহাত মন্দ শুনাইল না। “ভিড়ের মধ্যে নাচাইতে পারিব না” ; এবং “ঘরের কোণে পূজা করি।” সুতরাং কথার লড়াইয়ে তখনকার মত একরকম জিতিয়া যাই এবং মনু-পরাশর মাথায় করিয়া পরস্পরের পিঠ ঠুকিয়া দিয়া ঘরে ফিরিয়া আসি। অবশ্য সাহেবদের কাছে আমি হঠিতে বলি না, কিন্তু ঘরে ফিরিয়া দুই ভায়ে যদি বলাবলি করি, “ভায়া, পূজা ত করি, কিন্তু কিভাবে করি, বল ত?” তখন কিন্তু এমন অনেক কথাই বাহির হইয়া পড়িবার সম্ভাবনা যাহা বাহিরের লোকের কানে কিছুতেই তোলা চলে না। অতএব, আমাদের এটা নিভৃত আলোচনা।

প্রথম, সতীত্বের বাড়া নারীর আর গুণ নাই। সব দেশের পুরুষই এ কথা বোঝে, কেন না, এটা পুরুষের কাছে সবচেয়ে উপাদেয় সামগ্রী। এবং স্বামীর অবাধ্য হওয়া,—তিনি অতি বড় পাষণ্ড হইলেও—তাঁহাকে মনে মনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মত দোষ আর নাই। একটা অপরটার corollary; এই সতীত্ব যে নারীর কতবড় ধর্ম হওয়া উচিত, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদিতে সে কথার পুনঃ পুনঃ আলোচনা হইয়া গিয়াছে। এ দেশে এ তর্ক এত অধিক হইয়াছে যে, এ সম্বন্ধে আর বলিবার কিছু নাই। এখানে স্বয়ং ভগবান পর্যন্ত সতীত্বের দাপটে কতবার অস্থির হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু সমস্ত তর্কই একতরফা—একা নারীরই জন্য। [চলবে]

প্রতিক্ষণ/এডি/সাইমুম

 

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G