সাক্ষাৎকারের আড়ালে ন্যারেটিভের খেলা

প্রকাশঃ অক্টোবর ৩০, ২০২৫ সময়ঃ ১:০৯ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:০৯ পূর্বাহ্ণ

রাকিব হাসান

মজার বিষয় হচ্ছে—সাম্প্রতিক ঘটনাটি যেন পাঠ্যবইয়ের মতো করে মিডিয়া–ন্যারেটিভ অপারেশন কীভাবে কাজ করে, তার নমুনা দেখাল। প্রথমে দেশীয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ট্রেলার’ ছোঁড়া হলো—এক সাংবাদিক বললেন, “প্রয়োজনে জেলেও যাবো।” আবেগ, নাটক, বীরত্ব—সব মশলা উপস্থিত। এরপর আন্তর্জাতিক মিডিয়া “মেইন ফিল্ম” রিলিজ করল।

এছাড়া কে-না-কে কোথায় কী বলল, কে ‘নিষ্ঠুরতা’র শিকার হলেন—এসব দিয়ে একটি “পরিকল্পিত সহানুভূতি আন্দোলন” তৈরির চেষ্টা হলো।

একে কি বলা যায় না—Narrative Softening Strategy?

এটা এমন এক কৌশল, যেখানে অপরাধ, অভিযোগ, দমন-পীড়নের স্মৃতি জনমানস থেকে ধীরে ধীরে ধুয়ে ফেলা হয়। প্রথমে আবেগের মোড়ক, তারপর “ভুল বোঝাবুঝি”, পরে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা”, আর শেষে “বড় ভুল করেছি”—এমন করে মানুষের স্মৃতিকে পুনরায় প্রোগ্রাম করা হয়।

এ যেন জনমতকে ঘোরে আচ্ছন্ন করে রাখা এক ধোঁয়ার পর্দা—যেখানে সত্য হেঁটে যায় পেছন দিক দিয়ে।

কিন্তু সমস্যাটা আরও গভীর—এই মিডিয়া-গেমে ভিকটিমরা অদৃশ্য হয়ে যায়।

যখন সাংবাদিকতার আলো একজন ক্ষমতাবানকে “আবার মানুষ” বানানোর চেষ্টা করে, তখন সেই আলোচনার বাইরে রয়ে যায় সেই মায়ের কণ্ঠ—যিনি আজও খুঁজে ফিরছেন সন্তানের রক্তমাখা ব্যাগটা।

এ আলোচনার বাইরে রয়ে যায় সেই ছাত্রের অপূর্ণ স্বপ্ন—যার ইউনিভার্সিটির ফর্ম ফিলাপ করার আগেই দুনিয়া থেকে নাই হয়ে গেল।

এ আলোচনার বাইরে রয়ে যায় সেই বাবার নীরব চোখ—যিনি প্রতিদিন রাত তিনটায় দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন- ছেলে ফিরবে বলে। অথচ এসব চাপা দিয়ে তার সাক্ষাতকার ছাপা হয়।

এই ন্যারেটিভ কি ন্যায্য?

মিডিয়ার দায়িত্ব কি সত্য আড়াল করা, নাকি সত্য উদঘাটন করা?

মানুষ কি দেখতে পায় সত্য? নাকি তাদের দেখানো সত্যই সত্যে পরিণত হয়?

মিডিয়ার সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে—কাকে নায়ক বানাবে, কাকে খলনায়ক বানাবে—তা তারা ঠিক করে দিতে পারে।

আজকের সাংবাদিকতা, বিশেষত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, অনেক সময় সত্য খোঁজার চেয়ে গল্প বানাতে বেশি উৎসাহী। কারণ গল্প বিক্রি হয়, সত্য নয়।

সত্য যত কঠিন, বিক্রি তত কম।

এবার আমরা দেখি—কেন এই সাক্ষাৎকার এখন? কাকে উদ্দেশ্য করে? কে লাভবান হবে?

১) আন্তর্জাতিক মহলে সহানুভূতির হাওয়া তৈরি করা—যাতে ভবিষ্যৎ কোনো রাজনৈতিক দর-কষাকষিতে নৈতিক পয়েন্ট আদায় করা যায়।

২) স্বদেশে বিচার প্রক্রিয়াকে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা” হিসেবে ব্র্যান্ডিং করে সেটিকে প্রহসনের বিচার হিসেবে দেখানো।

৩) পরবর্তীতে দেশে ফেরার রুট প্রস্তুত—“মানুষ তো আমাকে চায়”, এ ধারণা গড়ে দেওয়া।

৪) ভিকটিমদের স্বরধ্বনি স্তব্ধ রাখা—কারণ আবেগ ভাগ হলে সহানুভূতি ভাগ হয়ে যায়।

মিডিয়ার এই খেলা নতুন নয়।

স্বৈরশাসক বা বিতর্কিত শাসকের ইমেজ রিস্টোরেশন বিশ্বের বহু দেশে দেখা গেছে—মুবারক, গাদ্দাফি, রাজাপাকসে—সবাই একই টেমপ্লেট ব্যবহার করেছেন।

তাদের পুরনো সাউন্ড বাইট: “আমি সর্বস্ব দিয়েছি, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি।”

এটিকে বলে Political Redemption Script। এবং এর প্রধান চাবিকাঠি—মিডিয়া।

কিন্তু জনগণ কি এতই বিস্মৃত ও নির্বোধ যে সব ভুলে যাবে?

হ্যাঁ—যদি মিডিয়া তাদের ভুলিয়ে দেয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—গণমাধ্যম কি সত্যিই নিরপেক্ষ? তাদের কি কোনো অবস্থান নেই?

গণমাধ্যমও এখন ক্ষমতার বলয়, স্বার্থের কারখানা, আর ন্যারেটিভ বাণিজ্যের বাজার।

এখানে বার্তা বিক্রি হয় না—এখানে বিক্রি হয় দৃষ্টিভঙ্গি।

আজ ন্যারেটিভ তৈরি করার জন্য বড় বড় এজেন্সি আছে, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আছে, কনসালট্যান্সি আছে—যারা মানুষকে ভুলিয়ে দিতে খুব দক্ষ। একসময় যে শাসকের ছবি দেখে মানুষ ঘুমাতে পারত না, কিছুদিন পর সেই শাসকের কথা প্রচার হয়—“দেখো, উনিও তো মানুষ ছিলেন!”

গণমাধ্যমের শিল্প এখন সত্য বলা নয়—সত্যকে রঙ করা।

এখানেই সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। মিডিয়া যদি আপনাকে গল্প শোনায়, প্রশ্ন করুন—কার স্বার্থে গল্পটি বলা হলো?

কোন তথ্য বাদ দেওয়া হলো?

কার চোখের পানি আড়ালে রইলো?

আজকের মিডিয়া যদি সত্য না দেখায়, তাহলে পাঠকের দায়িত্ব—শব্দের আড়ালে লুকোনো অভিপ্রায় খুঁজে বের করা।

আমরা ভুলে গেলে চলবে না—একজন ক্ষমতাবানকে মিডিয়ার সাহায্যে ভিকটিম বানানো যায়, কিন্তু ভিকটিমদের চোখের জল শুকাতে মিডিয়ার কোনো ভূমিকা থাকে না।

ভিকটিমদের গল্প “ক্লিকবেইট” নয়, তাই তা প্রচার হয় না।

কারণ মৃত মানুষের কান্নায় “ট্রেন্ডিং” হয় না।

শেষে একটি বাস্তব প্রশ্ন—

কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়ে কি ইতিহাস পাল্টানো যায়?

মিডিয়া কি ন্যারেটিভ পাল্টাতে পারে—হ্যাঁ, সাময়িকভাবে পারে।

কিন্তু ইতিহাসের আদালত?

সেখানে কোনো “ইমোশনাল স্ক্রিপ্ট” কাজ করে না।

বিচার, সত্য, এবং জনগণের স্মৃতি—শেষ পর্যন্ত শব্দের ভিড় থেকে পথ খুঁজে নেয়।

মিডিয়া হয়তো সময়ের ক্যানভাসে কিছু রঙ ছড়াতে পারে, কিন্তু রঙ শুকিয়ে গেলে যে দাগ দেখা যায়—সেটাই সত্য।

লেখক: সম্পাদক, প্রতিক্ষণ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

November 2025
SSMTWTF
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930 
20G